পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8@S রবীন্দ্র-রচনাবলী বুঝি বশ করিবার বিদ্যা জানি বা। আশা হাসিয়া কহিল, “তুমি জান না তো কে জানে। তোমার বিদ্যা আমি একটুখানি পাইলে বাচিয়া যাইতাম।” বিনোদিনী। কেন, কার সর্বনাশ করিবার ইচ্ছা হইয়াছে। ঘরে যেটি আছে, সেইটিকে রক্ষা কর, পরকে ভোলাইবার চেষ্টা করিস নে ভাই বালি। বড়ো ল্যাঠা । আশা বিনোদিনীকে হস্তদ্বারা তর্জন করিয়া বলিল, “আঃ, কী বকিস, তার ঠিক নেই।” কাশী হইতে ফিরিয়া আসার পর প্রথম সাক্ষাতেই মহেন্দ্ৰ কহিল, “তোমার শরীর বেশ ভালো - ছিল দেখিতেছি, দিব্য মোটা হইয়া আসিয়ােছ।” আশা অত্যন্ত লজাবোধ করিল। কোনোমতেই তাহার শরীর ভালো থাকা উচিত ছিল না— কিন্তু মূঢ় আশার কিছুই ঠিকমত চলে না; তাহার মন যখন এত খারাপ ছিল, তখনো তাহার পোড়া শরীর মোটা হইয়া উঠিয়াছিল; একে তো মনের ভাব ব্যক্ত করিতে কথা জোটে না, তাহাতে আবার শরীরটাও উলটা বলিতে থাকে। আশা মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কেমন ছিলো।” আগে হইলে মহেন্দ্ৰ কতক ঠাট্টা, কতক মনের সঙ্গে বলিত, "মরিয়া ছিলাম।” এখন আর ঠাট্টা করিতে পারিল না, গলার কাছে আসিয়া বাধিয়া গেল। কহিল, “ বেশ ছিলাম, মন্দ ছিলাম না।” আশা চাহিয়া দেখিল, মহেন্দ্র পূর্বের চেয়ে যেন রোগাই হইয়াছে- তাহার মুখ পাণ্ডুবৰ্ণ, চােখে একপ্রকার তীব্র দীপ্তি। একটা যেন আভ্যন্তরিক ক্ষুধায় তাহাকে অগ্নিজিহবা দিয়া লেহন করিয়া খাইতেছে। আশা মনে মনে ব্যথা অনুভব করিয়া ভাবিল, “আহা, আমার স্বামী ভালো ছিলেন না, কেন আমি উহাকে ফেলিয়া কাশী চলিয়া গেলাম।” স্বামী রোগ হইলেন, অথচ নিজে মোটা হইল, ইহাতেও নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি আশার অত্যন্ত ধিককার জন্মিল। মহেন্দ্র আর কী কথা তুলিবে ভাবিতে ভাবিতে খানিক বাদে জিজ্ঞাসা করিল, “কাকীমা ভালো আছেন "তো ?” সে প্রশ্নের উত্তরে কুশল-সংবাদ পাইয়া তাহার আর দ্বিতীয় কথা মনে আনা দুঃসাধ্য হইল। কাছে একটা ছিন্ন পুরাতন খবরের কাগজ ছিল, সেইটো টানিয়া লইয়া মহেন্দ্ৰ অন্যমনস্কভাবে পড়িতে লাগিল। আশা মুখ নিচু করিয়া ভাবিতে লাগিল, “এতদিন পরে দেখা হইল, কিন্তু উনি আমার সঙ্গে কেন ভালো করিয়া কথা কহিলেন না, এমন-কি, আমার মুখের দিকেও যেন চাহিতে পারিলেন না। আমি তিন-চার দিন চিঠি লিখিতে পারি নাই বলিয়া কি রাগ করিয়াছেন, আমি মাসির অনুরোধে বেশি দিন কাশীতে ছিলাম বলিয়া কি বিরক্ত হইয়াছেন।” অপরাধ কোন ছিদ্ৰ দিয়া কেমন করিয়া প্রবেশ করিল, ইহাই সে নিতান্ত ক্লিষ্টহীদয়ে সন্ধান করিতে লাগিল । মহেন্দ্ৰ কলেজ হইতে ফিরিয়া আসিল । অপরাহুে জলপানের সময় রাজলক্ষ্মী ছিলেন, আশাও রাজলক্ষ্মী উদবিগ্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ কি তোর অসুখ করিয়াছে মহিনী।” মহেন্দ্র বিরক্তভাবে কহিল, “না মা, অসুখ কেন করবে।” রাজলক্ষ্মী। তবে তুই যে কিছু খাইতেছিস না ! মহেন্দ্ৰ পুনর্বার উত্ত্যক্তস্বরে কহিল, “এই তো, খাচ্ছি না তো কী।” মহেন্দ্ৰ গ্ৰীষ্মের সন্ধ্যায় একখানা পাতলা চাদর গায়ে ছাদের এধারে ওধারে বেড়াইতে লাগিল । মনে বড়ো আশা ছিল, তাহদের নিয়মিত পড়াটা আজ ক্ষান্ত থাকিবে না। আনন্দমঠ প্ৰায় শেষ হইয়াছে, আর গুটি দুই-তিন অধ্যায় বাকি আছে মাত্র। বিনোদিনী যত নিষ্ঠুর হােক সে-কয়টা অধ্যায় আজ তাহাকে নিশ্চয় শুনাইয়া যাইবে । কিন্তু সন্ধ্যা অতীত হইল, সময় উত্তীর্ণ হইয়া গেল, গুরুভার নৈরাশ্য বহিয়া মহেন্দ্ৰকে শুইতে যাইতে হইল। সজিত লজান্বিত আশা ধীরে ধীরে শয়নকক্ষে প্ৰবেশ করিল। দেখিল, বিছানায় মহেন্দ্ৰ শুইয়া