পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 (፩ br রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বিনোদিনী কী একটা বলিবার জন্য উদ্যত হইয়া নিজেকে সংবরণ করিল- কহিল, “সে কথা ঠিক পিসিমা, কেহ কাহাকেও জানে না। নিজের মনও কি সবাই জানে। তুমি কি কখনো তোমার বউয়ের উপর দ্বেষ করিয়া এই মায়াবিনীকে দিয়া তোমার ছেলের মন ভুলাইতে চাও নাই ? একবার ঠাওর করিয়া দেখো দেখি।” রাজলক্ষ্মী অগ্নির মতো উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিলেন— কহিলেন, “হতভাগিনী, ছেলের সম্বন্ধে মার নামে তুই এমন অপবাদ দিতে পারিস ? তোর জিব খসিয়া পড়িবে না!” বিনোদিনী অবিচলিতভাবে কহিল, “পিসিমা, আমরা মায়াবিনীর জাত, আমার মধ্যে কী মায়া ছিল, তাহা আমি ঠিক জানি নাই, তুমি জানিয়াছ— তোমার মধ্যেও কী মায়া ছিল, তাহা তুমি ঠিক জান নাই, আমি জানিয়াছি। কিন্তু মায়া ছিল, নহিলে এমন ঘটনা ঘটিত না। ফাদ। আমিও কতকটা জানিয়া এবং কতকটা না জানিয়া পাতিয়াছি। ফাদ তুমিও কতকটা জানিয়া এবং কতকটা না জানিয়া পাতিয়াছ । আমাদের জাতের ধর্ম এইরূপ- আমরা মায়াবিনী।” রোষে রাজলক্ষ্মীরা যেন কণ্ঠরোধ হইয়া গেলা— তিনি ঘর ছাডিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন। বিনোদিনী একলা ঘরে ক্ষণকালের জন্য স্থির হইয়া দাড়াইয়া রহিল— তাহার দুই চক্ষে আগুন खूब्लिशा ठठेिब्न । সকালবেলাকার গৃহকার্য হইয়া গেলে রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। মহেন্দ্ৰ বুঝিল, কাল রাত্রিকার ব্যাপার লইয়া আলোচনা হইবে। তখন বিনোদিনীর কাছ হইতে পত্ৰোত্তর পাইয়া তাহার মন বিকল হইয়া উঠিয়াছিল। সেই আঘাতের প্রতিঘাত স্বরূপে তাহার সমস্ত তরঙ্গিত হৃদয় বিনোদিনীর দিকে সবেগে ধাবমান হইতেছিল। ইহার উপরে আবার মার সঙ্গে উত্তর-প্রত্যুত্তর করা তাহার পক্ষে অসাধ্য। মহেন্দ্ৰ জানিত, মা তাহাকে বিনোদিনী সম্বন্ধে ভৎসনা করিলেই বিদ্রোহীভাবে সে যথার্থ মনের কথা বলিয়া ফেলিবে এবং বলিয়া ফেলিলেই নিদারুণ গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হইবে । অতএব এ সময়ে বাড়ি হইতে দূরে গিয়া সকল কথা পরিষ্কার করিয়া ভাবিয়া দেখা দরকার। মহেন্দ্ৰ চাকরকে আসিয়া দেখা হইবে।” বলিয়া পলাতক বালকের মতো তখনই তাড়াতাডি কাপড় পরিয়া না খাইয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। বিনোদিনীর যে দারুণ চিঠিখানা আজ সকাল হইতে বার বার করিয়া সে পডিয়াছে এবং পকেটে লইয়া ফিরিয়াছে, আজ নিতান্ত তাড়াতাড়িতে সেই চিঠিসুদ্ধ জামা ছাডিয়াই সে চলিয়া গেল । এক পশিলা ঘন বৃষ্টি হইয়া তাহার পরে বাদলার মতো করিয়া রহিল। বিনোদিনীর মন আজ অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া আছে। মনের কোনো অসুখ হইলে বিনোদিনী কাজের মাত্রা বাড়ায়। তাই সে আজ যত রাজ্যের কাপড় জড়ো করিয়া চিহ্ন দিতে আরম্ভ করিয়াছে। আশার নিকট হইতে কাপড় চাহিতে গিয়া আশার মুখের ভাব দেখিয়া তাহার মন আরো বিগড়াইয়া গেছে। সংসারে যদি অপরাধীই হইতে হয় তবে অপরাধের যত লাঞ্ছনা। তাহাই কেন ভোগ করিবে, অপরাধের যত সুখ তাহা হইতে কেন বঞ্চিত হইবে । ঝুপ কুপ শব্দে চাপিয়া বৃষ্টি আসিল। বিনোদিনী তাহার ঘরে মেঝের উপর বসিয়া। সম্মুখে কাপড় স্তৃপকার। খেমি দাসী এক-একখানি কাপড় অগ্রসর করিয়া দিতেছে, আর বিনােদিনী মার্কা দিবার কালি দিয়া তাহাতে অক্ষর মুদ্রিত করিতেছে। মহেন্দ্ৰ কোনো সাড়া না দিয়া দরজা খুলিয়া একেবারে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। খেমি দাসী কাজ ফেলিয়া মাথায় কাপড় দিয়া ঘর ছাড়িয়া ছুট দিল । বিনোদিনী কোলের কাপড় মাটিতে ফেলিয়া দিয়া বিদ্যুদবেগে উঠিয়া দাড়াইয়া কহিল, “যাও, আমার এ ঘর হইতে চলিয়া যাও।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “কেন, কী করিয়াছি।” বিনোদিনী। কী করিয়াছি। ভীরু কাপুরুষ ! কী করিবার সাধ্য আছে তোমার। না জান ভালোবাসিতে, না জান কর্তব্য করিতে। মাঝে হইতে আমাকে কেন লোকের কাছে নষ্ট করিতেছা!