পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 V(? লাগিল। প্ৰথমে বাহির হইতে কে আসিল। সূর্যস্তকালের করুণ রক্তিমােচ্ছটায় আভাসিত আশার লজ্জামণ্ডিত তরুণ মুখখানি অন্ধকারে অঙ্কিত হইয়া উঠিল, তাহার সঙ্গে-সঙ্গে মঙ্গল-উৎসবের পুণ্যশঙ্খধ্বনি তাহার কানে বাজিতে লাগিল। এই শুভগ্ৰহ অদৃষ্টাকাশের অজ্ঞাত প্ৰান্ত হইতে আসিয়া দুই বন্ধুর মাঝখানে দাড়াইল- একটু যেন বিচ্ছেদ আনিল, কোথা হইতে এমন একটি গৃঢ় বেদনা আনিয়া উপস্থিত করিল, যাহা মুখে বলিবার নহে, যাহা মনেও লালন করিতে নাই। কিন্তু তবু এই বিচ্ছেদ, এই বেদনা অপূর্ব স্নেহরঞ্জিত মাধুর্যরশ্মি দ্বারা আচ্ছন্ন পরিপূর্ণ হইয়া রহিল। তাহার পরে যে শনিগ্রহের উদয় হইল— বন্ধুর প্রণয়, দম্পতির প্রেম, গৃহের শান্তি ও পবিত্ৰতা একেবারে ছারখার করিয়া দিল, বিহারী প্ৰবল ঘূণায় সেই বিনোদিনীকে সমস্ত অন্তঃকরণের সহিত সুন্দরে ঠেলিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু এ কী আশ্চর্য। আঘাত যেন অত্যন্ত মৃদু হইয়া গেল, তাহাকে যেন স্পর্শ করিল না। সেই পরমাসুন্দরী প্ৰহেলিকা তাহার দুৰ্ভেদ্যরহস্যপূর্ণ ঘনকৃষ্ণ অনিমেষ দৃষ্টি লইয়া কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে বিহারীর সম্মুখে স্থির হইয়া দাড়াইল। গ্ৰীষ্মরাত্রির উচ্ছসিত দক্ষিণ চক্ষুর জালাময়ী দীপ্তি স্নান হইয়া আসিতে লাগিল; সেই তৃষাশুষ্ক খরদৃষ্টি অশ্রুজালে সিক্ত স্নিগ্ধ হইয়া গভীর ভাববাসে দেখিতে দেখিতে পরিপ্লত হইয়া উঠিল ; মুহুর্তের মধ্যে সেই মূর্তি বিহারীর পায়ের কাছে পড়িয়া তাহার দুই জানু প্ৰাণপণ বলে বক্ষে চাপিয়া ধরিল— তাহার পরে সে একটি অপরূপ মায়ালতার মতো নিমেষের মধ্যেই বিহারীকে বেষ্টন করিয়া বাডিয়া উঠিয়া সদ্যোবিকশিত সুগন্ধি পুষ্পমঞ্জরিতুল্য একখানি চুম্বনেন্মখ মুখ বিহারীর ওষ্ঠের নিকট আনিয়া উপনীত করিল। বিহারী চক্ষু কোনোমতেই তাহাকে আঘাত করিতে যেন তাহার হাত উঠিল না— একটি অসম্পূণ ব্যাকুল চুম্বন তাহার মুখের কাছে আসন্ন হইয়া রহিল, পুলকে তাহাকে আবিষ্ট করিয়া তুলিলা। ” বিহারী ছাদের নির্জন অন্ধকারে আর থাকিতে পারিল না। আর-কোনো দিকে মন দিবার জন্য সে তাড়াতাড়ি দীপালোকিত ঘরের মধ্যে আসিয়া প্ৰবেশ করিল। কোণে টিপাইয়ের উপর রেশমের-ঢাকা-দেওয়া একখানি বাধানো ফোটোগ্রাফ ছিল। বিহারী ঢাকা খুলিয়া সেই ছবিটি ঘরের মাঝখানে আলোর নীচে লইয়া বসিল- কোলের উপর রাখিয়া দেখিতে লাগিল । ছবিটি মহেন্দ্র ও আশার বিবাহের অনতিকাল পরের যুগলমূর্তি। ছবির পশ্চাতে মহেন্দ্র নিজের অক্ষরে ‘মহিনদা এবং আশা স্বহস্তে "আশা" এই নামটুকু লিখিয়া দিয়াছিল। ছবির মধ্যে সেই নবপরিণয়ের মধুর দিনটি আর ঘুচিল না। মহেন্দ্ৰ চৌকিতে বসিয়া আছে, তাহার মুখে নূতন বিবাহের একটি নবীন সরস ভাবাবেশ ; পাশে আশা দাড়াইয়া— ছবিওয়ালা তাহাকে মাথায় ঘোমটা দিতে দেয় নাই, কিন্তু তাহার মুখ হইতে লজ্জাটুকু খসাইতে পারে নাই। আজ মহেন্দ্র তাহার পার্শ্বচরী আশাকে কাদাইয়া কতদূরে চলিয়া যাইতেছে, কিন্তু জড় ছবি মহেন্দ্রের মুখ হইতে নবীন প্রেমের একটি রেখাও এই ছবিখানি কোলে লইয়া বিহারী বিনোদিনীকে ধিককারের দ্বারা সুদূরে নির্বাসিত করিতে চাহিল। কিন্তু বিনোদিনীর সেই প্ৰেমে-কাতর যৌবনে-কোমল বাহুদুটি বিহারীর জানু চাপিয়া রহিল। বিহারী মনে মনে কহিল, ‘এমন সুন্দর প্রেমের সংসার ছারখার করিয়া দিলি!” কিন্তু বিনোদিনীর সেই উর্ধের্বাৎক্ষিপ্ত ব্যাকুল মুখের চুম্বন-নিবেদন তাহাকে নীরবে কহিতে লাগিল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি। সমস্ত জগতের মধ্যে আমি তোমাকে বরণ করিয়াছি।” কিন্তু এই কি জবাব হইল। এই কথাই কি একটি ভগ্ন সংসারের নিদারুণ আর্তস্বরকে ঢাকিতে পারে । পিশাচী ! h পিশাচী ! বিহারী এটা কি পুরা ভৎসনা করিয়া বলিল, না, ইহার সঙ্গে একটুখানি আদরের সুর আসিয়াও মিশিলা। যে মুহুর্তে বিহারী তাহার সমস্ত জীবনের সমস্ত প্রেমের দাবি হইতে বঞ্চিত হইয়া O