পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি SAS হইবে— দয়া যদি কর তবে বাচিব ; না যদি কর তবে তোমার পথ হইতে দূরে চলিয়া যাইব । আমি সংসারে নানা অবিশ্বাসের কাজ করিয়াছি, কিন্তু আজ আমাকে অবিশ্বাস করিয়ো না। আমরা প্ৰলয়ের মুখে দাড়াইয়াছি, এখন ছলনা করিবার সময় নহে।” গাড়ি আছে ?” মহেন্দ্ৰ কহিল, “আছে।” বিনোদিনীর দিদিশাশুড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া কহিল, “মহেন্দ্ৰ, তুমি আমাকে চেন না, কিন্তু তুমি আমার পর নও। তোমার মা রাজলক্ষ্মী আমাদের গ্রামেরই মেয়ে, গ্রামসম্পর্কে আমি তাহার মামী। জিজ্ঞাসা করি, এ তোমার কী রকম ব্যবহার। ঘরে তোমার স্ত্রী আছে, মা আছে, আর তুমি এমন বেহায়া হইয়া, উন্মত্ত হইয়া ফিরিতেছ! ভদ্রসমাজে তুমি মুখ দেখাইবে কী বলিয়া।” মহেন্দ্ৰ যে ভাবোন্মাদের রাজ্যে ছিল, সেখানে এই একটা আঘাত লাগিল। তাহার মা আছে, স্ত্রী আছে, ভদ্রসমাজ বলিয়া একটা ব্যাপার আছে। এই সহজ কথাটা নুতন করিয়া যেন মনে উঠিল। এই অজ্ঞাত সুন্দর পল্লীর অপরিচিত গৃহদ্বারে মহেন্দ্ৰকে যে এমন কথা শুনিতে হইবে, ইহা তাহার এক সময়ে স্বপ্নেরও অতীত ছিল। দিনের বেলায় গ্রামের মাঝখানে দাড়াইয়া সে একটি ভদ্রঘরের বিধবা রমণীকে ঘর হইতে পথে বাহির করিতেছে, মহেন্দ্রের জীবনচরিতে এমনও একটা অদ্ভুত অধ্যায় লিখিত হইল। তবু তাহার মা আছে, স্ত্রী আছে এবং ভদ্রসমাজ আছে । মহেন্দ্র যখন নিরুত্তর হইয়া দাড়াইয়া রহিল, তখন বৃদ্ধ কহিল, “যাইতে হয় তো এখনই যাও, এখনই যাও । আমার ঘরের দাওয়ায় দাড়াইয়া থাকিয়ো না— আর এক মুহুর্তও দেরি করিয়ো না।” বলিয়া বৃদ্ধ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল। অস্নাত অভুক্ত মলিনবস্ত্ৰ বিনোদিনী শান্য হস্তে গাড়িতে গিয়া উঠিল। মহেন্দ্র যখন গাড়িতে উঠিতে গেল, বিনোদিনী কহিল, “না, স্টেশন দূরে নয়, তুমি হাটিয়া যাও।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “তাহা হইলে গ্রামের সকল লোক আমাকে দেখিতে পাইবে ।” বিনোদিনী কহিল, “এখনো তোমার লজার বাকি আছে ?” বলিয়া গাড়ির দরজা বন্ধ করিয়া গাডোয়ান জিজ্ঞাসা করিল, “বাবু যাইবে না ?” মহেন্দ্র একটু ইতস্তত করিয়া আর যাইতে সাহস করিল না । গাড়ি চলিয়া গেল। মহেন্দ্র গ্রামের পথ পরিত্যাগ করিয়া মাঠের পথ দিয়া ঘুরিয়া নতশিরে স্টেশনের অভিমুখে চলিল। তখন গ্রামবধূদের স্নানাহার হইয়া গেছে। কেবল যে-সকল কর্মনিষ্ঠা প্ৰৌঢ়া গৃহিণী বিলম্বে অবকাশ পাইয়াছে, তাহারাই গামছা ও তেলের বাটি লইয়া আম্রমুকুলে আমোদিত ছায়াসিন্ধ পুষ্করিণীর নিভূত ঘাটে চলিয়াছে। 8 ○ মহেন্দ্ৰ কোথায় নিরুদ্দেশ হইয়া গেল, সেই আশঙ্কায় রাজলক্ষ্মীর আহারনিদ্রা বন্ধ। সাধুচরণ সম্ভব-অসম্ভব সকল স্থানেই তাহাকে খুজিয়া বেড়াইতেছে— এমন সময় মহেন্দ্ৰ বিনোদিনীকে লইয়া কলিকাতায় ফিরিয়া আসিল । পটলডাঙার বাসায় তাহাকে রাখিয়া রাত্ৰে মহেন্দ্ৰ তাহার বাডিতে আসিয়া পৌছিল। রাখা হইয়াছে। রাজলক্ষ্মী রোগীর ন্যায় বিছানায় শুইয়া আছেন এবং আশা পদতলে বসিয়া আস্তে আস্তে তাহার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতেছে। এতকাল পরে গৃহের বধূ শাশুড়ির পদতলের অধিকার পাইয়াছে।