পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Գ 8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বই লইয়া মহেন্দ্ৰ চলিয়া গেছে। পরদিন একাদশী ছিল। অসুস্থ ক্লিষ্টদেহ রাজলক্ষ্মী বিছানায় পড়িয়া ছিলেন। বাহিরে ঘন মেঘে ঝড়ের উপক্রম করিয়াছে। আশা ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। আস্তে আস্তে রাজলক্ষ্মীর পায়ের কাছে বসিয়া তাহার পায়ে হাত দিয়া কহিল, “তোমার দুধ ও ফল আনিয়াছি, খাবে এসো।” করুণমূর্তি বধুর এই অনভ্যস্ত সেবার চেষ্টা দেখিয়া রাজলক্ষ্মীর শুষ্ক চক্ষু প্লাবিত হইয়া গেল। তিনি উঠিয়া বসিয়া আশাকে কোলে লইয়া তাহার অশ্রুজলসিক্ত কপোল চুম্বন করিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহিন এখন কী করিতেছে বউমা ।” আশা অত্যন্ত লজ্জিত হইল— মৃদুস্বরে কহিল, “তিনি চলিয়া গেছেন।” রাজলক্ষ্মী । কখন চলিয়া গেল, আমি তো জানিতেও পারি নাই। আশা নতশিরে কহিল, “তিনি কাল রাত্রেই গেছেন।” শুনিবা মাত্র রাজলক্ষ্মীর সমস্ত কোমলতা যেন দূর হইয়া গেল— বধূর প্রতি তাহার আদরষ্পর্শের মধ্যে আর রসলেশমাত্র রহিল না। আশা একটা নীরব লাঞ্ছনা অনুভব করিয়া নতমুখে আস্তে আস্তে চলিয়া গেল । 8 ) প্রথম রাতে বিনোদিনীকে পটলডাঙার বাসায় রাখিয়া মহেন্দ্র যখন তাহার কাপড় ও বই আনিতে বাড়ি গেল, বিনোদিনী তখন কলিকাতার বিশ্রামবিহীন জনতরঙ্গের কোলাহলে একলা বসিয়া নিজের কথা ভাবিতেছিল। পৃথিবীতে তাহার আশ্রয়স্থান কোনোকালেই যথেষ্ট বিস্তীর্ণ ছিল না, তবু তাহার এক পাশ তাতিয়া উঠিলে আর-একপাশে ফিরিয়া শুইবার একটুখানি জায়গা ছিল— আজ তাহার নির্ভরস্থল অত্যন্ত সংকীর্ণ। সে যে নৌকায় চড়িয়া স্রোতে ভাসিয়াছে, তাহা দক্ষিণে বামে একটু কান্ত হইলেই একেবারে জলের মধ্যে গিয়া পড়িতে হইবে। অতএব বড়োই স্থির হইয়া হাল ধরা চাই, একটু ভুল, একটু নাড়াচাড়া সহিবে না। এ অবস্থায় কোন রমণীর হৃদয় না কম্পিত হয়। পরের মন সম্পূৰ্ণ বশে রাখিতে যেটুকু লীলাখেলা চাই, যেটুকু অন্তরালের প্রয়োজন, এই সংকীর্ণতার মধ্যে তাহার অবকাশ কোথায়। একেবারে মহেন্দ্রের সহিত মুখোমুখি করিয়া তাহাকে সমস্ত জীবন যাপন করিতে প্ৰস্তুত হইতে হইবে। প্ৰভেদ এই যে, মহেন্দ্রের কুলে উঠিবার উপায় আছে, কিন্তু বিনোদিনীর তাহা নাই। বিনোদিনী নিজের এই অসহায় অবস্থা যতই সুস্পষ্ট বুঝিল ততই সে মনের মধ্যে বলসঞ্চয় করিতে লাগিল। একটা উপায় তাহাকে করিতেই হইবে, এভাবে তাহার। চলিবে না। যেদিন বিহারীর কাছে বিনোদিনী নিজের প্ৰেম নিবেদন করিয়াছে, সেদিন হইতে তাহার ধৈর্যের বাধ ভাঙিয়া গেছে। যে উদ্যত চুম্বন বিহারীর মুখের কাছ হইতে সে ফিরাইয়া লইয়া আসিয়াছে, জগতে তাহা কোথাও আর নামাইয়া রাখিতে পারিতেছে না, পূজার অর্ঘ্যের ন্যায় দেবতার উদ্দেশে তাহা রাত্ৰিদিন বহন করিয়াই রাখিয়াছে। বিনোদিনীর হৃদয় কোনো অবস্থাতেই সম্পূৰ্ণ হাল ছাড়িয়া দিতে জানে না— নৈরাশ্যকে সে স্বীকার করে না। তাহার মন অহরহ প্ৰাণপণ বলে বলিতেছে, “আমার এ পূজা বিহারীকে গ্রহণ করিতেই হইবে।” বিনোদিনীর এই দুর্দান্ত প্রেমের উপরে তাহার আত্মরক্ষার একান্ত আকাঙক্ষা যোগ দিল। বিহারী ছাড়া তাহার। আর উপায় নাই। মহেন্দ্ৰকে বিনোদিনী খুব ভালো করিয়াই জানিয়াছে, তাহার উপরে নির্ভর করিতে গেলে সে ভর সয় না— তাহাকে ছাডিয়া দিলে তবেই তাহাকে পাওয়া যায়, তাহাকে ধরিয়া থাকিলে সে ছুটিতে চায়। কিন্তু নারীর পক্ষে যে নিশ্চিন্ত বিশ্বস্ত নিরাপদ নির্ভর একান্ত আবশ্যক, বিহারীই তাহা দিতে পারে। আজ আর বিহারীকে ছাড়িলে বিনোদিনীর একেবারেই চলিবে না। মহেন্দ্ৰকে দিয়া বিনোদিনী স্টেশনের সংলগ্ন পোস্ট-আপিসে বিশেষ করিয়া বলিয়া আসিয়াছিল।