পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Գ Ե՞ রবীন্দ্র-রচনাবলী ভজু কহিল, “সে আজ চার-পাচ দিন হইয়া গেছে। তিনি পশ্চিমে কোথায় বেড়াইতে গেছেন।” শুনিয়া মহেন্দ্ৰ বাচিয়া গেল। তাহার মনে হইল, “এইবার একটু শুইয়া আরামে ঘুমাই, আর সমস্ত রাত ঘুরিয়া বেড়াইতে পারি না।” বলিয়া উপরে উঠিয়া বিহারীর ঘরে কোঁচের উপর শুইয়া তৎক্ষণাৎ ঘুমাইয়া পড়িল । মহেন্দ্ৰ যে-রাত্রে বিহারীর ঘরে আসিয়া উপদ্ৰব করিয়াছিল, তাহার পরদিনই বিহারী কোথায় যাইতে হইবে, কিছুই স্থির না করিয়া পশ্চিমে চলিয়া গেছে। বিহারী ভাবিল, এখানে থাকিলে পূর্ববন্ধুর সহিত সংঘর্ষ কোন-একদিন এমন বীভৎস হইয়া উঠিবে যে, তাহার পর চিরজীবন অনুতাপের কারণ থাকিয়া যাইবে । পরদিন মহেন্দ্র যখন উঠিল তখন বেলা এগারোটা। উঠিয়াই সম্মুখের টিপাইয়ের উপর তাহার দৃষ্টি পড়িল। দেখিল, বিনোদিনীর হস্তাক্ষরে বিহারীর নামে এক পত্র পাথরের কাগজ চাপা দিয়া চাপা। রহিয়াছে। তাড়াতাড়ি তাহা তুলিয়া লইয়া দেখিল, পত্র এখনো খোলা হয় নাই। প্রবাসী বিহারীর জন্য তাহা অপেক্ষা করিয়া আছে। কম্পিতহস্তে মহেন্দ্ৰ তাড়াতাড়ি তাহা খুলিয়া পড়িতে লাগিল। এই চিঠিই বিনোদিনী তাহদের গ্রাম হইতে বিহারীকে লিখিয়াছিল এবং ইহার কোনো জবাব সে পায় নাই। চিঠির প্রত্যেক অক্ষর মহেন্দ্ৰকে দংশন করিতে লাগিল। বাল্যকাল হইতে বরাবর বিহারী মহেন্দ্রের অন্তরালেই পড়িয়া ছিল। জগতের সেহিপ্ৰেম সম্বন্ধে মহেন্দ্র-দেবতার শুষ্ক নির্মাল্যই তাহার ভাগো জুটিত । আজ মহেন্দ্ৰ স্বয়ং প্রার্থী এবং বিহারী বিমুখ, তবু মহেন্দ্ৰকে ঠেলিয়া বিনোদিনী এই অরসিক বিহারাকেই বরণ করিল। মহেন্দ্রও বিনোদিনীর দুই-চারিখানি চিঠি পাইয়াছে, কিন্তু বিহারীর এ চিঠির কাছে তাহা নিতান্ত কৃত্ৰিম, তাহা নির্বোধকে ভুলাইবার শূন্য ছলনা। নূতন ঠিকানা জানাইবার জন্য গ্রামের ডাকঘরে মহেন্দ্ৰকে পাঠাইতে বিনোদিনীর ব্যগ্রতা মহেন্দ্রের মনে পড়িল এবং তাহার কারণ সে বুঝিতে পারিল। বিনোদিনী তাহার সমস্ত মন-প্ৰাণ দিয়া বিহারীর চিঠির উত্তর পাইবার জন্য পথ চাহিয়া বসিয়া আছে। পূর্বপ্রথামত মনিব না থাকিলেও ভজু বেহারিা মহেন্দ্ৰকে চা এবং বাজার হইতে জলখাবার আনিয়া খাওয়াইল। মহেন্দ্ৰ স্নান ভুলিয়া গেল। উত্তপ্ত বালুকার উপর দিয়া পথিক যেমন দ্রুতপদে চলে, মহেন্দ্ৰ সেইরূপ ক্ষণে ক্ষণে বিনোদিনীর জ্বালােকর চিঠির উপর দ্রুত চোখ বুলাইতে লাগিল। মহেন্দ্র পণ করিতে লাগিল, বিনোদিনীর সঙ্গে আর কিছুতেই দেখা করিবে না। কিন্তু তাহার মনে হইল, আর দুই-একদিন চিঠির জবাব না পাইলে বিনোদিনী বিহারীর বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইবে এবং তখন সমস্ত অবস্থা জানিতে পারিয়া সাস্তুনা লাভ করিবে। সে সম্ভাবনা তাহার কাছে অসহ্য বোধ হইল । তখন চিঠিখানা পকেটে করিয়া মহেন্দ্ৰ সন্ধ্যার কিছু পূর্বে পটলডাঙার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল । মহেন্দ্রের স্নান অবস্থায় বিনোদিনীর মনে দয়া হইল— সে বুঝিতে পারিল, মহেন্দ্ৰ কাল রাত্রে হয়তো পথে-পথে অনিদ্রায় যাপন করিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিল, “কাল রাত্রে বাড়ি যাও নাই ?” মহেন্দ্ৰ কহিল, “না।” বিনোদিনী ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “আজ এখনো তোমার খাওয়া হয় নি নাকি ৷” বলিয়া সেবাপরায়ণা বিনোদিনী তৎক্ষণাৎ আহারের আয়োজন করিতে উদ্যত হইল । বিনোদিনী । কোথায় খাইয়াছ। মহেন্দ্ৰ। বিহারীদের বাড়িতে। মুহুর্তের জন্য বিনোদিনীর মুখ পাণ্ডুবৰ্ণ হইয়া গেল। মুহুর্তকাল নিরুত্তর থাকিয়া আত্মসংবরণ করিয়া বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারী-ঠাকুরপো ভালো আছেন তো ?” মহেন্দ্ৰ কহিল, “ভালোই আছে। বিহারী যে পশ্চিমে চলিয়া গেল।”— মহেন্দ্র এমন ভাবে বলিল, যেন বিহারী আজই রওনা হইয়াছে।