পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

と br ○ রবীন্দ্র-রচনাবলী 8、 রাত্রেই মহেন্দ্ৰ শয্যা ছাড়িয়া গেছে শুনিয়া রাজলক্ষ্মী বধূর প্রতি অত্যন্ত রাগ করিলেন। মনে করিলেন, আশার লাঞ্ছনাতেই মহেন্দ্ৰ চলিয়া গেছে। রাজলক্ষ্মী আশাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহেন্দ্ৰ কাল রাত্ৰে চলিয়া গেল কেন ।” আশা মুখ নিচু করিয়া বলিল, “জানি না, মা।” রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, এটাও অভিমানের কথা। বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “তুমি জান না তো বে: জানিবে। তাহাকে কিছু বলিয়াছিলে ?” আশা কেবলমাত্ৰ বলিল, “না।” রাজলক্ষ্মী বিশ্বাস করিলেন না। এ কি কখনো সম্ভব হয় । জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাল মহিনী কখন গেল।” আশা সংকুচিত হইয়া কহিল, “জানি না।” রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত রাগিয়া উঠিয়া কহিলেন, “তুমি কিছুই জান না! কচি খুকি ! তোমার সব চালাকি ৷” আশারই আচরণে ও স্বভাবদোষেই যে মহেন্দ্ৰ গৃহত্যাগী হইয়াছে, এ মত ও রাজলক্ষ্মা তীব্রস্বরে ঘোষণা কবিয়া দিলেন । আশা নতমস্তকে সেই শুৎসনা বহন করিয়া নিজের ঘরে গিয়া কাদিতে লাগিল । সে মনে মনে ভাবিল, ‘কেন যে আমাকে আমার স্বামী একদিন ভালোবাসিয়াছিলেন, তাহা আমি জানি না এবং কেমন করিয়া যে তাহাব ভালোবাসা ফিরিয়া পাইব, তাহাও আমি বলিতে পারি না।” যে লোক ভালোবাসে, তাহাকে কেমন করিয়া খুশি কবিতে হয়, তাহা হৃদয় আপনি বলিয়া দেয় ; কিন্তু যে ভালোবাসে না, তাহার মন কী করিয়া পাইতে হয়, আশা তাহার কী জানে। যে লোক অন্যাকে ভালোবাসে, তাহার নিকট হইতে সোহাগ লইতে যাওয়ার মতো এমন নিরতিশয় লেজার্কর চেষ্টা সে কেমন করিয়া কবিবে | সন্ধাকালে বাডির দৈবজ্ঞঃ-ঠাকুর এবং তাহার ভগিনী আচাৰ্য-ঠাকরুন আসিয়াছেন ; ছেলের গ্রহশান্তির জন্য রাজলক্ষ্মী ইত্ব দিগকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছিলেন । রাজলক্ষ্মী একবার বউমার কোষ্ঠী এবং হাত দেখিবার জন্য দৈবজ্ঞকে অনুরোধ করিলেন এবং সেই উপলক্ষে। আশাকে উপস্থিত করিলেন; } পরের কাছে নিজের দুভাগা-আলোচনার সংকোচে একান্ত কুষ্ঠিত হইয়া আশা কোনোমতে তাহাব হাত বাহির কবিয়া বসিয়াছে, এমন সময় রাজলক্ষ্মী তাহার ঘরের পাশ্বস্থ দীপহীন বারান্দা দিয়া মৃদু জুতার শব্দ পাইলেন- কে যেন গোপনে চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছে । রাজলক্ষ্মী ডাকিলেন, “ কে ও !” প্ৰথমে সাড়া পাইলেন না । তাহার পর আবার ডাকিলেন, “ কে যায় গো ।” তখন নিরুত্তরে মহেন্দ্ৰ ঘবের মধ্যে প্ৰবেশ করিল। আশা খুশি হইবে কি, মহেন্দ্রের লজা দেখিযা লজ্জায় তাহার হৃদয় ভরিয়া গেল। মহেন্দ্ৰকে এখন নিজের বাডিতেও চোরের মতো প্ৰবেশ করিতে হয় | দৈবজ্ঞ এবং আচার্য-ঠাকরুন বসিয়া আছেন। বলিয়া তাহার আরো লজা হইল। সমস্ত পৃথিবীর কাছে নিজের স্বামীব জনা যে লজ, ইহাই আশার দুঃখের চেয়েও যেন বেশি হইয়া উঠিয়াছে। রাজলক্ষ্মী যখন মৃদুস্বরে বউকে বলিলেন, “বউমা, পার্বতীকে বলিয়া দাও, মহিনের খাবার গুছাইয়া আনে”, তখন আশা কহিল, “মা, আমিই আনিতেছি।” বাড়ির দাসদাসীদের দৃষ্টি হইতেও সে মহেন্দ্রকে ঢাকিয়া রাখিতে চায়। এ দিকে আচার্য ও তাহার ভগিনীকে দেখিয়া মহেন্দ্ৰ মনে মনে অত্যন্ত রাগ করিল। তাহার মাতা ও স্ত্রী দৈবসহায়ে তাহাকে বশ করিবার জন্য এই অশিক্ষিত মৃঢ়দের সহিত নির্লজ্জভাবে যড়যন্ত্র করিতেছে, ইহা মহেন্দ্রের কাছে অসহ্য বোধ হইল। ইহার উপর যখন আচাৰ্য্য-ঠাকরুন কণ্ঠস্বরে অতিরিক্ত মধুমাখা স্নেহরসের সঞ্চার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভালো আছ তো বাবা”— তখন মহেন্দ্ৰ আর বসিয়া থাকিতে পারিল না ; কুশলপ্রশ্নের কোনো উত্তব না দিয়া কহিল, “মা, আমি একবার