পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8brミ রবীন্দ্র-রচনাবলী হাতের অক্ষরগুলির প্রতি মহেন্দ্রের হৃদয়হীন বিদ্রুপদৃষ্টি কল্পনা করিয়া সে আর এক মুহুৰ্তও দাড়াইতে পারিল না। দ্রুতপদে নীচে চলিয়া গেল- পদশব্দ গোপন করিবার চেষ্টাও রহিল না। রহস্যালাপে প্ৰবৃত্ত আছে; সেইজন্য খাবার লইয়া গিয়া মাঝখানে ভঙ্গ দিতে তাহার প্রবৃত্তি হইতেছিল না। আশাকে নীচে আসিতে দেখিয়া তিনি ভোজনস্থলে আহার লইয়া মহেন্দ্ৰকে খবর দিলেন। মহেন্দ্ৰ খাইতে উঠিবামাত্র আশা ঘরের মধ্যে ছুটিয়া গিয়া নিজের ছবিখানা ছিড়িয়া লইয়া ছাদের প্রাচীর ডিঙাইয়া ফেলিয়া দিল, এবং তাহার খাতপত্রগুলা তাড়াতাড়ি তুলিয়া লইয়া গেল। আহারান্তে মহেন্দ্ৰ শয়নগৃহে আসিয়া বসিল। রাজলক্ষ্মী বধূকে কাছাকাছি কোথাও খুঁজিয়া পাইলেন না। অবশেষে একতলায় রন্ধনশালায় আসিয়া দেখিলেন, আশা তাহার জন্য দুধ জ্বাল দিতেছে। কোনো আবশ্যক ছিল না। কারণ, যে-দাসী রাজলক্ষ্মীর রাত্রের দুধ প্রতিদিন জ্বাল দিয়া থাকে, সে নিকটেই ছিল এবং আশার এই অকারণ উৎসাহে আপত্তি প্ৰকাশ করিতেছিল ; বিশুদ্ধ জলের দ্বারা পূরণ করিয়া দুধের যে অংশটুকু সে হরণ করিত, সেটুকু আজ ব্যর্থ হইবার সম্ভাবনায় সে মনে মনে ব্যাকুল হইতেছিল। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “এ কী বউমা, এখানে কেন । যাও, উপরে যাও।” আশা উপরে গিয়া তাহার শাশুড়ির ঘর আশ্রয় করিল। রাজলক্ষ্মী বধুর ব্যবহারে বিরক্ত হইলেন। ভাবিলেন, “যদি বা মহেন্দ্ৰ মায়াবিনীর মায়া কাটাইয়া ক্ষণকালের জন্য বাড়ি আসিল, বউ রাগারগি মান-অভিমান করিয়া আবার তাহাকে বাড়ি-ছাড়া করিবার চেষ্টায় আছে। বিনোদিনীর ফাদে মহেন্দ্ৰ যে ধরা পড়িল, সে তো আশারই দোষ । পুরুষমানুষ তো স্বভাবতই বিপথে যাইবার জন্য প্ৰস্তুত, স্ত্রীর কর্তব্য তাহাকে ছলে বলে কৌশলে সিধা পথে রাখা ।” রাজলক্ষ্মী তীব্র ভৎসনার স্বরে কহিলেন, “ তোমার এ কী রকম ব্যবহার, বউমা ! তোমার ভাগ্যক্রমে স্বামী যদি ঘরে আসিলেন, তুমি মুখ হাঁড়িপনা করিয়া আমন কোণে-কোণে লুকাইয়া বেড়াইতেছ। কেন ।” আশা নিজেকে অপরাধিনী জ্ঞান করিয়া অঙ্কুশাহতচিত্তে উপরে চলিয়া গেল, এবং মনকে দ্বিধা করিবার অবকাশমাত্র না দিয়া এক নিশ্বাসে ঘরের মধ্যে গিয়া উপস্থিত হইল। দশটা বাজিয়া গেছে । মহেন্দ্র ঠিক সেই সময় বিছানার সম্মুখে দাড়াইয়া অনাবশ্যক দীর্ঘকাল ধরিয়া চিন্তিতমুখে মশারি ঝাড়িতেছে। বিনোদিনীর উপরে তাহার মনে একটা তীব্র অভিমানের উদয় হইয়াছে। সে মনে মনে বলিতেছিল, “বিনোদিনী কি আমাকে তাহার এমনই ক্রীতদাস বলিয়া নিশ্চয় স্থির করিয়া রাখিয়াছে যে, আশার কাছে আমাকে পাঠাইতে তাহার মনে লেশমাত্র আশঙ্কা জন্মিল না। আজ হইতে যদি আমি দাড়াইবে । আমি কি এতই অপদার্থ যে, এই কর্তব্য-পালনের ইচ্ছা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব । বিনোদিনীর কাছে কি শেষকালে আমার এই পরিচয় হইল। শ্রদ্ধাও হারাইলাম, ভালোবাসাও পাইলাম না, আমাকে অপমান করিতে তাহার দ্বিধাও হইল না ?’ মহেন্দ্ৰ মশারির সম্মুখে দাড়াইয়া দৃঢ়চিত্তে প্ৰতিজ্ঞা করিতেছিল, বিনোদিনীর এই স্পর্ধার সে প্ৰতিবাদ করিবে, যেমন করিয়া হউক আশার প্রতি হৃদয়কে অনুকুল করিয়া বিনোদিনীকৃত অবমাননার প্রতিশোধ দিবে। আশা যেই ঘরে প্রবেশ করিল, মহেন্দ্রের অন্যমনস্ক মশারি-ঝাড়া আমনি বন্ধ হইয়া গেল। কী বলিয়া আশার সঙ্গে সে কথা আরম্ভ করিবে, সেই এক অতিদুরূহ সমস্যা উপস্থিত হইল। মহেন্দ্ৰ কাষ্ঠহাসি হাসিয়া, হঠাৎ তাহার যে কথাটা মুখে আসিল তাঁহাই বলিল। কহিল, “তুমিও দেখিলাম আমার মতো পড়ায় মন দিয়াছ। খাতপত্র এই যে এখানে দেখিয়াছিলাম, সেগুলি গোল কোথায় ।” কথাটা যে কেবল খাপছাড়া শুনাইল তাঁহা নহে, আশাকে যেন মারিল। মূঢ় আশা যে শিক্ষিতা হইবার চেষ্টা করিতেছে, সেটা তাহার বড়ো গোপন কথা— আশা স্থির করিয়াছিল, এ কথাটা বড়োই