পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 དེ་ S་ রবীন্দ্র-রচনাবলী অনুরোধ আছে। এই চিঠি পড়িয়া আশা স্তম্ভিত হইয়া গেল— প্রবল ধিককার তাহার দুঃখকে অতিক্রম করিয়া উঠিল। এই নিষ্ঠুর বার্তা মাকে কেমন করিয়া শুনাইবে। আশার বিলম্বে রাজলক্ষ্মী অধিকতর উদবিগ্ন হইয়া উঠিলেন। কহিলেন, “বউমা, মহিন কী লিখিয়াছে শীঘ্র আমাকে শুনাইয়া দাও।” বলিতে বলিতে তিনি আগ্রহে বিছানায় উঠিয়া বসিলেন। আশা তখন ঘরে আসিয়া ধীরে ধীরে সমস্ত চিঠি পড়িয়া শুনাইল । রাজলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিলেন, “শরীরের কথা মহিন কী লিখিয়াছে, ঐখানটা আর-একবার পড়ে তো।” আশা পুনরায় পড়িল, “কিছুদিন হইতেই আমি তেমন ভালো বোধ করিতেছিলাম না, তাই আমি রাজলক্ষ্মী। থাক থাক, আর পড়িতে হইবে না। ভালো বোধ হইবে কী করিয়া। বুড়ো মা মরেও না, অথচ কেবল ব্যামো লইয়া তাহাকে জ্বালায়। কেন তুমি মহিনকে আমার অসুখের কথা খবর দিতে গেলে । বাড়িতে ছিল, ঘরের কোণে বসিয়া পড়াশুনা করিতেছিল, কাহারও কোনো এলাকায় ছিল না— মাঝে হইতে মার ব্যামোর কথা পাড়িয়া তাহাকে ঘরছাড়া করিয়া তোমার কী সুখ হইল । আমি এখানে মরিয়া থাকিলে তাহাতে কাহার কী ক্ষতি হইত । এত দুঃখেও তোমার ঘটে এইটুকু বুদ্ধি আসিল না ? বলিয়া বিছানার উপর শুইয়া পড়িলেন। বাহিরে মসিমস শব্দ শুনা গেল। বেহারিা কহিল, “ডাক্তারবাবু আয়া।” ডাক্তার কাশিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। আশা তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া খাটের অন্তরালে গিয়া দাড়াইল। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার কী হইয়াছে বলুন তো।” রাজলক্ষ্মী ক্ৰোধের স্বরে কহিলেন, “হইবে। আর কী। মানুষকে কি মরিতে দিবে না। তোমার ওষুধ খাইলেই কি অমর হইয়া থাকিব ।” ডাক্তার সান্তুনার স্বরে কহিল, “আমরা করিতে না পারি, কষ্ট যাহাতে কমে সে চেষ্টা—” রাজলক্ষ্মী বলিয়া উঠিলেন, “কষ্টের ভালো চিকিৎসা ছিল যখন বিধবারা পুড়িয়া মরিত— এখন এ তো কেবল বাধিয়া মারা। যাও ডাক্তারবাবু, তুমি যাও— আমাকে আর বিরক্ত করিয়ো না, আমি একলা থাকিতে চাই ।” ডাক্তার ভয়ে ভয়ে কহিল, “আপনার নাড়িটা একবার—” রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত বিরক্তির স্বরে কহিলেন, “আমি বলিতেছি, তুমি যাও । আমার নাড়ি বেশ আছে- এ নাড়ি শাস্ত্ৰ ছাড়িবে এমন ভরসা নাই।” ডাক্তার অগত্যা ঘরের বাহিরে গিয়া আশাকে ডাকিয়া পাঠাইল । আশাকে নবীন-ডাক্তার রোগের সমস্ত বিবরণ জিজ্ঞাসা করিল। উত্তরে সমস্ত শুনিয়া গভীরভাবে ঘরের মধ্যে পুনরায় প্রবেশ করিল। কহিল, “ দেখুন, মহেন্দ্র আমার উপর বিশেষ করিয়া ভার দিয়া গেছে। আমাকে যদি আপনার চিকিৎসা করিতে না দেন, তবে সে মনে কষ্ট পাইবে।” মহেন্দ্ৰ কষ্ট পাইবে, এ কথাটা রাজলক্ষ্মীর কাছে উপহাসের মতো শুনাইল— তিনি কহিলেন, “মহিনের জন্য বেশি ভাবিয়ো না । কষ্ট সংসারে সকলকেই পাইতে হয় । এ কষ্টে মহেন্দ্ৰকে অত্যন্ত বেশি কাতর করিবে না। তুমি এখন যাও ডাক্তার। আমাকে একটু ঘুমাইতে দাও।” নবীন-ডাক্তার বুঝিল, রোগীকে উত্তাক্ত করিলে ভালো হইবে না ; ধীরে ধীরে বাহিরে আসিয়া যাহা যাহা কর্তব্য। আশাকে উপদেশ দিয়া গেল । আশা ঘরে ঢুকিতে রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “যাও বাছা, তুমি একটু বিশ্রাম করো গে। সমস্ত দিন রোগীর কাছে বসিয়া আছ। হারুর মাকে পাঠাইয়া দাও— পাশের ঘরে বসিয়া থাক।” আশা রাজলক্ষ্মীকে বুঝিত। ইহা তাহার মেহের অনুরোধ নহে, ইহা তাহার আদেশ— পালন করা ছাড়া আর উপায় নাই। হারুর মাকে পাঠাইয়া দিয়া অন্ধকারে সে নিজের ঘরে গিয়া শীতল ভূমিশয্যায় শুইয়া পড়িল ।