পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8&br রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বিহারী কহিল, “তোমার হাতের মাছের ঝোল না খাইলে আমার এ হাড় কিছুতেই ঢাকিবে না। তুমি শীঘ্র শীঘ্ৰ সারিয়া ওঠে। মা, আমি ততক্ষণ রান্নার আয়োজন করিয়া রাখি।” রাজলক্ষ্মী স্নান হাসি হাসিয়া কহিলেন, “সকাল সকাল আয়োজন কর বাছা— কিন্তু রান্নার নয়।” বলিয়া বিহারীর হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, “ বেহারি, তুই বউ ঘরে নিয়ে আয়, তোকে দেখিবার লোক কেহ নাই। ও মেজেবিউ, তোমরা এবার বেহারির একটি বিয়ে দিয়ে দাও— দেখো-না, বাছার চেহারা কেমন হইয়া গেছে।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “তুমি সারিয়া ওঠে, দিদি। এ তো তোমারই কাজ, তুমি সম্পন্ন করিবে, আমরা সকলে যোগ দিয়া আমোদ করিব।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার আর সময় হইবে না, মেজেবিউ, বেহারির ভার তোমাদেরই উপর রহিল— উহাকে সুখী করিয়ো, আমি উহার ঋণ শুধিয়া যাইতে পারিলাম না— কিন্তু ভগবান উহার ভালো করিবেন।” বলিয়া বিহারীর মাথায় তাহার দক্ষিণ হস্ত বুলাইয়া দিলেন। আশা আর ঘরে থাকিতে পারিল না— কান্দিবার জন্য বাহিরে চলিয়া গেল। অন্নপূর্ণ অশ্রুজিলের ভিতর দিয়া বিহারীর মুখের প্রতি মেহদৃষ্টিপাত করিলেন। রাজলক্ষ্মীর হঠাৎ কী মনে পড়িল- তিনি ডাকিলেন, “বউমা, ও বউমা।” আশা ঘরে প্রবেশ করিতেই কহিলেন, “ বেহারির খাবারের সব ব্যবস্থা করিয়াছ তো ?” বিহারী কহিল, “মা, তোমার এই পেটুক ছেলেটিকে সকলেই চিনিয়া লইয়াছে। দেউড়িতে ছুটিয়াছে— বুঝিলাম, এ বাড়িতে এখনো আমার খ্যাতি লুপ্ত হয় নাই!” বলিয়া বিহারী হাসিয়া একবার আশার মুখের দিকে চাহিল। আশা আজ আর লজ্জা পাইল না। সে স্নেহের সহিত স্মিতহাস্যে বিহারীর পরিহাস গ্রহণ করিল। বিহারী যে এ সংসারের কতখানি, আশা তাহা আগে সম্পূৰ্ণ জনিত না— অনেক সময় তাহাকে আচরণে সুস্পষ্ট পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে; সেই অনুতাপের ধিককারে আজ বিহারীর প্রতি তাহার শ্রদ্ধা এবং করুণা সবেগে ধাবিত হইয়াছে। হইবে- আমাদের এই বাঙালি ছেলে একরাশ ঝাল নাহিলে খাইতে পারে না।” বিহারী। তোমার মা ছিলেন বিক্রমপুরের মেয়ে, তুমি নদীয়া জেলার ভদ্রসস্তানকে বাঙাল বল ? এ তো আমার সহ্য হয় না । ইহা লইয়া অনেক পরিহাস হইল, এবং অনেক দিন পরে মহেন্দ্রের বাড়ির বিষাদাভার যেন লঘু লইয়া আসিল । কিন্তু এত কথাবার্তার মধ্যে কোনো পক্ষ হইতে কেহ মহেন্দ্রের নাম উচ্চারণ করিল না। পূর্বে বিহারীর সঙ্গে মহেন্দ্রের কথা লইয়াই রাজলক্ষ্মীর একমাত্ৰ কথা ছিল। তাহা লইয়া মহেন্দ্ৰ নিজে তাহার মাতাকে অনেকবার পরিহাস করিয়াছে। আজ সেই রাজলক্ষ্মীর মুখে মহেন্দ্রের নাম একবারও না শুনিয়া বিহারী মনে মনে স্তম্ভিত হইল । রাজলক্ষ্মীর একটু নিদ্রাবেশ হইতেই বিহারী বাহিরে আসিয়া অন্নপূর্ণাকে কহিল, “মার ব্যামো তো সহজ নহে ।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “সে তো স্পষ্টই দেখা যাইতেছে।” বলিয়া তাহার ঘরের জানালার কাছে বসিয়া পড়িলেন। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, “একবার মহিনকে ডাকিয়া আনিবি না, বেহারি ? আর তো দেরি করা উচিত হয় না।” বিহারী কিছুক্ষণ নিরুত্তরে থাকিয়া কহিল, “তুমি যেমন আদেশ করিবে আমি তাঁহাই করিব |