পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 তাহার ঠিকানা কেহ কি জানে।” অন্নপূর্ণা। ঠিক জানে না, খুঁজিয়া লইতে হইবে। বিহারী, আর-একটা কথা তোর কাছে বলি। আশার মুখের দিকে চাস। বিনোদিনীর হাত হইতে মহেন্দ্ৰকে যদি উদ্ধার করিতে না পারিস। তবে সে আর বঁচিবে না। তাহার মুখ দেখিলেই বুঝিতে পারিবি, তার বুকে মৃত্যুবাণ বাজিয়াছে। বিহারী মনে মনে তীব্ৰ হাসি হাসিয়া ভাবিল, ‘পরকে উদ্ধার আমি করিতে যাইব- ভগবান, আমার উদ্ধার কে করিবে।” কহিল, “বিনোদিনীর আকর্ষণ হইতে চিরকালের জন্য মহেন্দ্ৰকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারিব, এমন মন্ত্র আমি কি জানি কাকীমা ? মার ব্যামোতে সে দুদিন শাস্ত হইয়া থাকিতে পারে, কিন্তু আবার সে যে ফিরিবে না, তাহা কেমন করিয়া বলিব ।” এমন সময় মলিনবাসনা আশা মাথায় আধখানা ঘোমটা দিয়া ধীরে ধীরে তাহার মাসিমার পায়ের কাছে আসিয়া বসিল। সে জানিত রাজলক্ষ্মীর পীড়া সম্বন্ধে বিহারীর সঙ্গে অন্নপূর্ণার আলোচনা চলিতেছে, তাই ঔৎসুক্যের সহিত শুনিতে আসিল। পতিব্ৰতা আশার মুখে নিস্তব্ধ দুঃখের নীরব মহিমা দেখিয়া বিহারীর মনে এক অপূর্ব ভক্তির সঞ্চার হইল। শোকের তপ্ত তীৰ্থজলে অভিষিক্ত হইয়া এই তরুণী রমণী প্ৰাচীন যুগের দেবীদের ন্যায় একটি আচঞ্চল মর্যাদা লাভ করিয়াছে— সে এখন আর সামান্য নারী নহে, সে যেন দারুণ দুঃখে পুরাণবর্ণিতা সাধবীদের সমান বয়স প্রাপ্ত হইয়াছে। বিহারী আশার সহিত রাজলক্ষ্মীর পথ্য ও ঔষধ সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া যখন আশাকে বিদায় করিল। তখন একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া অন্নপূৰ্ণাকে কহিল, “মহেন্দ্ৰকে আমি উদ্ধার করিব।” বিহারী মহেন্দ্রের ব্যাঙ্কে গিয়া খবর পাইল যে, তাহদের এলাহাবাদ শাখার সহিত মহেন্দ্ৰ অল্পদিন হইতে লেনদেনা আরম্ভ করিয়াছে। ( O স্টেশনে আসিয়া বিনোদিনী একেবারে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে মেয়েদের গাড়িতে চড়িয়া বসিল । মহেন্দ্ৰ কহিল, “ও কী করা, আমি তোমার জন্য সেকেণ্ড ক্লাসের টিকিট কিনিতেছি।” বিনোদিনী কহিল, “দরকার কী, এখানে আমি বেশ থাকিব ।” মহেন্দ্ৰ আশ্চর্য হইল। বিনোদিনী স্বভাবতই শৌখিন ছিল। পর্বে দারিদ্র্যের কোনো লক্ষণ তাহার কাছে প্রীতিকর ছিল না ; নিজের সাংসারিক দৈন্য সে নিজের পক্ষে অপমানকর বলিয়াই মনে করিত। মহেন্দ্ৰ এটুকু বুঝিয়াছিল যে, মহেন্দ্রের ঘরের অজস্র সচ্ছলতা, বিলাস উপকরণ এবং সাধারণের কাছে ধনী বলিয়া তাহাদের গৌরব, এক কালে বিনোদিনীর মনকে আকর্ষণ করিয়াছিল। সে অনায়াসেই এই ধনসম্পদ, এই-সকল আরাম ও গৌরকের ঈশ্বরী হইতে পারিত, সেই কল্পনায় তাহার মনকে একান্ত উত্তেজিত করিয়া তুলিয়াছিল। আজ যখন মহেন্দ্রের উপর প্রভুত্বলাভ করিবার সময় হইল, না চাহিয়াও সে যখন মহেন্দ্রের সমস্ত ধনসম্পদ নিজের ভোগে আনিতে পারে, তখন কেন সে এমন অসহ্য উপেক্ষার সহিত একান্ত উদ্ধতভাবে কষ্টকর। লজ্জাকর দীনতা স্বীকার করিয়া লইতেছে। মহেন্দ্রের প্রতি নিজের নির্ভরকে সে সথাসম্ভব সংকুচিত করিয়া রাখিতে চায়। যে উন্মত্ত মহেন্দ্ৰ বিনোদিনীকে তাহার স্বাভাবিক আশ্রয় হইতে চিরজীবনের জন্য চু্যত করিয়াছে, সে মহেন্দ্রের হাত হইতে সে এমন কিছুই চাহে না, যাহা তাহার এই সর্বনাশের মূল্যস্বরূপ গণ্য হইতে পারে। মহেন্দ্রের ঘরে যখন বিনোদিনী ছিল, তখন তাহার আচরণে বৈধব্যব্রতের কাঠিন্য বড়ো একটা ছিল না, কিন্তু এতদিন পরে সে আপনাকে সর্বপ্রকার ভোগ হইতে বঞ্চিত করিয়াছে। এখন সে একবেলা খায়, মোটা কাপড় পরে, তাহার সেই অনগল উৎসারিত হাস্যপরিহাসই বা গেল কোথায় । এখন সে এমন স্তব্ধ, এমন আবৃত, এমন সুদূর, এমন ভীষণ হইয়া উঠিয়াছে যে, মহেন্দ্ৰ তাহাকে সামান্য একটা কথাও জোর করিয়া বলিতে সাহস পায় না। মহেন্দ্ৰ আশ্চর্য হইয়া, অধীর হইয়া, ক্রুদ্ধ হইয়া কেবলই ভাবিতে লাগিল, “বিনোদিনী আমাকে এত চেষ্টায় দুর্লভ ফলের মতো এত উচ্চশাখা হইতে পাড়িয়া লইল,