পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি (? ON কর— তোমার একটা-কোনো ব্ৰতের একটা-কিছু ভার আমার উপর সমর্পণ করিয়ো, তাহাই বহন করিয়া আমি নিজেকে তোমার সেবিকা বলিয়া গণ্য করিব। কিন্তু ছিছি, বিধবাকে তুমি বিবাহ করিবে! তোমার ঔদার্যে সব সম্ভব হইতে পারে, কিন্তু আমি যদি এ কাজ করি, তোমাকে সমাজে নষ্ট করি, তবে ইহজীবনে আমি আর মাথা তুলিতে পারিব না। বিহারী । কিন্তু ব্রিনোদিনী, আমি তোমাকে ভালোবাসি। বিনোদিনী । সেই ভালোবাসার অধিকারে আমি আজ একটিমাত্র সম্পর্ধা প্ৰকাশ করিব । বলিয়া বিনোদিনী ভূমিষ্ঠ হইয়া বিহারীর পদাঙ্গুলি চুম্বন করিল। পায়ের কাছে বসিয়া কহিল, “পরজন্মে তোমাকে পাইবার জন্য আমি তপস্যা করিব- এ জন্মে আমার আর কিছু আশা নাই, প্ৰাপ্য নাই। আমি অনেক দুঃখ দিয়াছি, অনেক দুঃখ পাইয়াছি, আমার অনেক শিক্ষা হইয়াছে। সে শিক্ষা যদি ভুলিতাম, তবে আমি তোমাকে হীন করিয়া আরো হীন হইতাম। কিন্তু তুমি উচ্চ আছি বলিয়াই আজি আমি আবার মাথা তুলিতে পারিয়াছি— এ আশ্রয় আমি ভূমিসাৎ করিব না।” বিহারী গভীরমুখে চুপ করিয়া রহিল। বিনোদিনী হাতজোড় করিয়া কহিল, “ভুল করিয়ো না— আমাকে বিবাহ করিলে তুমি সুখী হইবে না, তোমার গৌরব যাইবে— আমিও সমস্ত গৌরব হারাইব। তুমি চিরদিন নির্লিপ্ত, প্রসন্ন। আজও তুমি তাই থাকো— আমি দূরে থাকিয়া তোমার কর্ম করি। তুমি প্ৰসন্ন হও, তুমি সুখী হও।” ○ ○ কহিল, “এখন ও-ঘরে যাইয়ো না।” মহেন্দ্ৰ জিজ্ঞাসা করিল, “কেন।” আশা কহিল, “ডাক্তার বলিয়াছেন। হঠাৎ মার মনে, সুখের হউক, দুঃখের হউক, একটা কোনো আঘাত লাগিলে বিপদ হইতে পারে।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “আমি একবার আস্তে আস্তে তাহার মাথার শিয়রের কাছে গিয়া দেখিয়া আসি গে।— তিনি টের পাইবেন না।” আশা কহিল, “তিনি অতি অল্প শব্দেই চমকিয়া উঠিতেছেন, তুমি ঘরে ঢুকিলেই তিনি টের পাইবেন ।” মহেন্দ্র। তবে, এখন তুমি কী করিতে চাও। আশা। আগে বিহারী-ঠাকুরপো আসিয়া একবার দেখিয়া যান।— তিনি যেরূপ পরামর্শ দিবেন, তাহাই করিব । বিহারী। বৌঠান, ডাকিয়াছ ? মা ভালো আছেন তো ? আশা বিহারীকে দেখিয়া যেন নির্ভর। পাইল। কহিল, “তুমি যাওয়ার পর হইতে মা যেন আরো চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছেন। প্রথম দিন তোমাকে না দেখিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিহারী কোথায় গেল।’ আমি বলিলাম, “তিনি বিশেষ কাজে গেছেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যে ফিরিবার কথা আছে।” তাহার পর হইতে তিনি থাকিয়া থাকিয়া চমকিয়া উঠিতেছেন। মুখে কিছুই বলেন না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে যেন কাহার অপেক্ষা করিতেছেন। কাল তোমার টেলিগ্রাম পাইয়া জানাইলাম, আজ তুমি আসিবে। শুনিয়া তিনি আজ তোমার জন্য বিশেষ করিয়া খাবার আয়োজন করিতে বলিয়াছেন। তুমি তিনি ঘরে হইতে দেখাইয়া দিবেন। ডাক্তারের নিষেধ কিছুতেই শুনিলেন না। আমাকে এই খানিকক্ষণ হইল ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, “বউমা, তুমি নিজের হাতে সমস্ত রাধিবে, আমি আজ সামনে বসাইয়া