পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি ( δ Σ. মহিনের নাম উচ্চারণমাত্র অনেক দিন পরে তাহার চোখ দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। সেই অশ্রু পড়িয়া তাহার হৃদয়ের বেদনা লঘু হইয়া আসিল। তখন মহেন্দ্ৰ উঠিয়া মাটিতে হাতে মহেন্দ্রের মাথা লইয়া তাহার মস্তক আত্মাণ করিলেন, তাহার ললাট চুম্বন করিলেন। মহেন্দ্র রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “মা, তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়াছি, আমাকে মাপ করে।” বক্ষ শাস্ত হইলে রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ও কথা বলিস নে মহিন, আমি তোকে মাপ না করিয়া কি বাচি। বউমা, বউমা কোথায় গেল।” আশা পাশের ঘরে পথ্য তৈরি করিতেছিল— অন্নপূর্ণ তাহাকে ডাকিয়া আনিলেন। তখন রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্ৰকে ভূতল হইতে উঠিয়া তাহার খাটে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। মহেন্দ্ৰ খাটে বসিলে রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের পার্শ্বে স্থান-নির্দেশ করিয়া আশাকে কহিলেন, “বউমা, এইখানে তুমি বসো— আজি আমি একবার তোমাদের দুজনকে একত্রে বসাইয়া দেখিব, তাহা হইলে আমার সকল দুঃখ ঘুচিবে। বউমা, আমার কাছে আর লজ্জা করিয়ো না— আর মহিনের পরেও মনের মধ্যে কোনো অভিমান না। রাখিয়া একবার এইখানে বসো-— আমার চোখ জুড়াও, মা।” তখন ঘোমটা-মাথায় আশা লজায় ধীরে ধীরে আসিয়া কম্পিত্যুবক্ষে মহেন্দ্রের পাশে গিয়া বসিল। রাজলক্ষ্মী স্বহস্তে আশার ডান হাত তুলিয়া লইয়া মহেন্দ্রের ডান হাতে রাখিয়া চাপিয়া ধরিলেন— কহিলেন, “আমার এই মাকে তোর হাতে দিয়া গেলাম, মহিন— আমার এই কথাটা মনে রাখিস, তুই এমন লক্ষ্মী আর কোথাও পাবি নে। মেজোবাউ, এসো, ইহাদের একবার আশীর্বাদ করো— তোমার পুণ্যে ইহাদের মঙ্গল হউক।” অন্নপূর্ণ সম্মুখে আসিয়া দাড়াইতেই উভয়ে চােখের জলে র্তাহার পদধূলি গ্রহণ করিল। অন্নপূর্ণ উভয়ের মস্তকচুম্বন করিয়া কহিলেন, “ভগবান তোমাদের কল্যাণ করুন।” রাজলক্ষ্মী। বিহারী, এসো বাবা, মহিনকে তুমি একবার ক্ষমা করো। বিহারী তখনই মহেন্দ্রের সম্মুখে আসিয়া দাড়াইতেই মহেন্দ্ৰ উঠিয়া দৃঢ়বাহু দ্বারা বিহারীকে বক্ষে টানিয়া কোলাকুলি করিল। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “মহিন, আমি তোকে এই আশীর্বাদ করি— শিশুকাল হইতে বিহারী তোর যেমন বন্ধু ছিল, চিরকাল তেমনি বন্ধু থাক— ইহার চেয়ে তোর সৌভাগ্য। আর-কিছু হইতে পারে না।” এই বলিয়া রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া নিস্তব্ধ হইলেন। বিহারী একটা উত্তেজক ঔষধ তাহার মুখের কাছে আনিয়া ধরিতেই রাজলক্ষ্মী হাত সরাইয়া দিয়া কহিলেন, “আর ওষুধ না, বাবা। এখন আমি ভগবানকে স্মরণ করি— তিনি আমাকে আমার সমস্ত সংসারদাহের শেষ ওষুধ দিবেন। মহিন, তোরা একটুখানি বিশ্রাম কর গে। বউমা, এইবার রান্না চড়াইয়া দাও।” সন্ধাবেলায় বিহারী এবং মহেন্দ্র রাজলক্ষ্মীর বিছানার সম্মুখে নীচে পাত পাড়িয়া খাইতে বসিল। আশার উপর রাজলক্ষ্মী পরিবেশনের ভার দিয়াছিলেন, সে পরিবেশন করিতে লাগিল । মহেন্দ্রের বক্ষের মধ্যে অশ্রু উদবেলিত হইয়া উঠিতেছিল, তাহার মুখে অন্ন উঠিতেছিল না। রাজলক্ষ্মী তাহাকে বার বার বলিতে লাগিলেন, “মহিন, তুই কিছুই খাইতেছিস না কেন। ভালো করিয়া খা, আমি দেখি ।” বিহারী কহিল, “জানই তো মা, মহিনদা চিরকাল ঐরকম, কিছুই খাইতে পারে না। বোঠান, ঐ ঘণ্টটা আমাকে আর-একটু দিতে হইবে, বড়ো চমৎকার হইয়াছে।” রাজলক্ষ্মী খুশি হইয়া ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “আমি জানি, বিহারী ঐ ঘণ্টটা ভালোবাসে। বউমা, ওটুকুতে কী হইবে, আর-একটু বেশি করিয়া দাও।” বিহারী কহিল, “তোমার এই বউটি বড়ো কৃপণ, হাত দিয়া কিছু গলে না।” রাজলক্ষ্মী হাসিয়া কহিলেন, “দেখো তো বউমা, বিহারী তোমারই নুন খাইয়া তোমারই নিন্দা করিতেছে।”