পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি Ꮹ: Ꮪ Ꮼ বিনোদিনী। তোমার আশীর্বাদ মিথ্যা হইবে না, পিসিমা । আমি তোমার পা ছুইয়া বলিতেছি আমা হইতে এ সংসারের মন্দ হইবে না। অন্নপূর্ণাকে বিনোদিনী ভূমিষ্ঠ হইয়া প্ৰণাম করিয়া খাইতে গেল। খাইয়া আসিলে পর রাজলক্ষ্মী তাহার দিকে চাহিয়া কহিলেন, “বউ, এখন তবে তুমি চলিলে ?” বিনোদিনী । পিসিমা, আমি তোমার সেবা করিব। ঈশ্বর সাক্ষী, আমা হইতে তুমি কোনো অনিষ্ট আশঙ্কা করিয়ো না । রাজলক্ষ্মী বিহারীর মুখের দিকে চাহিলেন। বিহারী একটু চিন্তা করিয়া কহিল, “বোঠান থাকুন মা, তাহাতে ক্ষতি হইবে না।” রাত্রে বিহারী, বিনোদিনী এবং অন্নপূর্ণা তিন জনে মিলিয়া রাজলক্ষ্মীর শুশ্রুষা করিলেন। এ দিকে আশা সমস্ত রাত্রি রাজলক্ষ্মীর ঘরে আসে নাই বলিয়া লজ্জায় অত্যন্ত প্ৰত্যুষে উঠিয়াছে। মহেন্দ্রকে বিছানায় সুপ্ত অবস্থায় রাখিয়া তাড়াতাড়ি মুখ ধুইয়া কাপড় ছাড়িয়া প্ৰস্তুত হইয়া আসিল । তখনো অন্ধকার একেবারে যায় নাই। রাজলক্ষ্মীর দ্বারের কাছে আসিয়া যাহা দেখিল, তাহাতে আশা অবাক হইয়া গেল। ভাবিল, “এ কি স্বপ্ন ।” তাহার জন্য চা তৈরি হইবে । আশাকে দেখিয়া বিনোদিনী উঠিয়া দাড়াইল। কহিল, “আজ আমি আমার সমস্ত অপরাধ লইয়া তোমার আশ্রয় গ্রহণ করিলাম— আর কেহ আমাকে দূর করিতে পরিবে না— কিন্তু তুমি যদি বল “যাও’ তো আমাকে এখনই যাইতে হইবে।” আশা কোনো উত্তর করিতে পারিল না- তাহার মন কী বলিতেছে, তাও সে যেন ভালো করিয়া বুঝিতে পারিল না, অভিভূত হইয়া রহিল। বিনোদিনী কহিল, “আমাকে কোনোদিন তুমি মাপ করিতে পরিবে না— সে চেষ্টাও করিয়ো না। কিন্তু আমাকে আর ভয় করিয়ো না । যে কয়দিন পিসিমার দরকার হইবে, সেই কটা দিন আমাকে একটুখানি কাজ করিতে দাও, তার পরে আমি চলিয়া যাইব ।” কাল রাজলক্ষ্মী যখন আশার হাত লইয়া মহেন্দ্রের হাতে দিলেন, তখন আশা তাহার মন হইতে সমস্ত অভিমান মুছিয়া ফেলিয়া সম্পূর্ণভাবে মহেন্দ্রের কাছে আত্মসমর্পণ করিয়াছিল। আজ বিনোদিনীকে সম্মুখে দেখিয়া তাহার খণ্ডিত প্রেমের দাহ শান্তি মানিল না। ইহাকে মহেন্দ্র একদিন ভালোবাসিয়াছিল, ইহাকে এখনো হয়তো মনে মনে ভালোবাসে- এ কথা তাহার বুকের ভিতরে দেখিবে- কী জানি কী চক্ষে দেখিবে । কাল রাত্রে আশা তাহার সমস্ত সংসারকে নিষ্কণ্টক দেখিয়াছিল— আজ প্ৰত্যুষে উঠিয়াই দেখিল, কঁাটাগাছ তাহার ঘরের প্রাঙ্গণেই। সংসারে সুখের স্থানই সব চেয়ে সংকীর্ণ- কোথাও তাঁহাকে সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে রাখিবার অবকাশ নাই। হৃদয়ের ভার লইয়া আশা রাজলক্ষ্মীর ঘরে প্রবেশ করিল, এবং অত্যন্ত লজার সঙ্গে কহিল, “মাসিম, তুমি সমস্ত রাত বসিয়া আছ — যাও, শুতে যাও।” অন্নপূর্ণ। আশার মুখের দিকে একবার ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিলেন। তাহার পরে শুইতে না গিয়া আশাকে নিজের ঘরে লইয়া গেলেন। কহিলেন, “চুনি, যদি সুখী হইতে চাস, তবে সব কথা মনে রাখিস নে। অন্যকে দোষী করিয়া যেটুকু সুখ, দোষ মনে রাখিবার দুঃখ তাহার চেয়ে ঢের বেশি।” ভুলিতে দেয় না যে ” অন্নপূর্ণ। বাছা, তুই ঠিক বলিয়াছিস— উপদেশ দেওয়া সহজ, উপায় বলিয়া দেওয়াই শক্ত। তবু আমি তোকে একটা উপায় বলিয়া দিতেছি। যেন ভুলিয়াছিস এই ভাবটি অন্তত বাহিরে প্রাণপণে রক্ষা করিতে হইবে— আগে বাহিরে ভুলিতে আরম্ভ করিস, তাহা হইলে ভিতরেও ভুলিবি। এ কথা মনে S Sys)