পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

( δ 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী রাখিস চুনি, তুই যদি না ভুলিস, তবে অন্যকেও স্মবণ করাইয়া রাখিবি ! তুই নিজের ইচ্ছায় না পারিস, আমি তোকে আজ্ঞা করিতেছি, তুই বিনোদিনীর সঙ্গে এমন ব্যবহার কর, যেন সে কখনো তোর কোনো অনিষ্ট করে নাই এবং তাহার দ্বারা তোর অনিষ্টের কোনো আশঙ্কা নাই। আশা নম্রমুখে কহিল, “কী করিতে হইবে, বলো।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “বিনোদিনী এখন বিহারীর জন্য চা তৈরি করিতেছে। তুই দুধ-চিনি-পেয়ালা সমস্ত লইয়া যা— দুই জনে মিলিয়া কাজ কর।” আশা আদেশ পালনের জন্য উঠিল। অন্নপূর্ণ কহিলেন, “এটা সহজ— কিন্তু আমার আর-একটি কথা আছে, সেটা আরো শক্ত— সেইটে তোকে পালন করিতেই হইবে । মাঝে মাঝে মহেন্দ্রের সঙ্গে বিনোদিনীর দেখা হইবেই, তখন তোর মনে কী হইবে, তাহা আমি জানি— সে-সময় তুই গোপন কটাক্ষেও মহেন্দ্রের ভাব কিংবা বিনোদিনীর ভাব দেখিবার চেষ্টামাত্ৰও করিস নে। বুক ফাটিয়া গেলেও তোকে অবিচলিত থাকিতে হইবে। মহেন্দ্ৰ ইহা জানিবে যে, তুই সন্দেহ কারিস না, শোক করিস না, তোর মনে ভয় নাই, চিন্তা নাই— জোড় ভাঙিবার পূর্বে যেমন ছিল, জোড় লাগিয়া আবার ঠিক তেমনই হইয়াছে— ভাঙনের দাগটুকুও মিলাইয়া গেছে। মহেন্দ্র কি আর-কেহ তোর মুখ দেখিয়া নিজেকে অপরাধী বলিয়া মনে করিবে না। চুনি, ইহা আমার অনুরোধ বা উপদেশ নহে, ইহা তোর মাসিমার আদেশ। আমি যখন কাশী চলিয়া যাইব, আমার এই কথাটি একদিনের জন্যও ভুলিস নে ৷” আশা চায়ের পেয়ালা প্রভৃতি লইয়া বিনোদিনীর কাছে উপস্থিত হইল। কহিল, “জল কি গরম হইয়াছে। আমি চায়ের দুধ আনিয়াছি।” বিনোদিনী আশ্চর্য হইয়া আশার মুখের দিকে চাহিল। কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো বারান্দায় বসিয়া আছেন, চা তুমি তাহার কাছে পাঠাইয়া দাও, আমি ততক্ষণ পিসিমার জন্য মুখ ধুইবার বন্দোবস্ত করিয়া রাখি। তিনি বোধ হয় এখনই উঠিবেন।” বিনোদিনী চা লইয়া বিহারীর কাছে গেল না । বিহারী ভালোবাসা স্বীকার করিয়া তাহাকে যে-অধিকার দিয়াছে, সেই অধিকার স্বেচ্ছামতে খাটাইতে তাহার সংকোচ বোধ হইতে লাগিল । অধিকারলাভের যে মর্যাদা আছে, সেই মর্যাদা রক্ষা করিতে হইলে অধিকারপ্রয়োগকে সংযত করিতে হয়। যতটা পাওয়া যায় ততটা লইয়া টানাটানি করা কাঙালিকেই শোভা পায়— ভোগকে খর্ব করিলেই সম্পদের যথার্থ গৌরব । এখন, বিহারী তাহাকে নিজে না ডাকিলে, কোনো-একটা উপলক্ষ করিয়া বিনোদিনী তাহার কাছে আর যাইতে পারে না । বলিতে—বলিতেই মহেন্দ্ৰ আসিয়া উপস্থিত হইল। আশার বুকের ভিতরটা যদিও ধড়াস করিয়া উঠিল, তবু সে আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া স্বাভাবিক স্বরে মহেন্দ্ৰকে কহিল, “তুমি এত ভোরে উঠিলে যে ? পাছে আলো লাগিয়া তোমার ঘুম ভাঙে তাই আমি জানালা-দরজা সব বন্ধ করিয়া আসিয়াছি।” বিনোদিনীর সম্মুখেই আশাকে এইরূপ সহজভাবে কথা কহিতে শুনিয়া মহেন্দ্রের বুকের একটা পাথর যেন নামিয়া গেল। সে আনন্দিতচিত্তে কহিল, “মা কেমন আছেন, তাই দেখিতে আসিয়াছি— মা কি এখনো ঘুমাইতেছেন।” আশা কহিল, “হা, তিনি ঘুমাইতেছেন, এখন তুমি যাইয়ো না। বিহারী-ঠাকুরপো বলিয়াছেন, তিনি আজ অনেকটা ভালো আছেন। অনেক দিন পরে কাল তিনি সমস্ত রাত ভালো করিয়া ঘুমাইয়াছেন।” আশা তাহার ঘর দেখাইয়া দিল । আশার এই দৃঢ়তা ও সংযম দেখিয়া বিনোদিনীও আশ্চর্য হইয়া গেল। মহেন্দ্ৰ ডাকিল, “কাকীমা !” অন্নপূর্ণ যদিও ভোরে স্নান করিয়া লইয়া এখন পূজায় বসিবেন স্থির করিয়াছিলেন তবুও তিনি