পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি (? Σ (ζ মহেন্দ্ৰ তাহাকে প্ৰণাম করিয়া কহিল, “কাকীমা, আমি পাপিষ্ঠ, তোমাদের কাছে আসিতে আমার লজা করে ।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “ছি ছি, ও কথা বলিস নে মহিন— ছেলে ধূলা লইয়াও মার কোলে আসিয়া বসে ।” মহেন্দ্ৰ। কিন্তু আমার এ ধুলা কিছুতেই মুছিবে না। কাকীমা। অন্নপূর্ণ। দুই-একবার ঝাড়িলেই ঝরিয়া যাইবে। মহিন, ভালোই হইয়াছে। নিজেকে ভালো বলিয়া তোর অহংকার ছিল, নিজের পরে বিশ্বাস তোর বড়ো বেশি ছিল, পাপের ঝড়ে তোর সেই গর্বটুকুই ভাঙিয়া দিয়াছে, আর কোনো অনিষ্ট করে নাই। মহেন্দ্র। কাকীমা, এবার তোমাকে আর ছাড়িয়া দিব না, তুমি গিয়াই আমার এই দুৰ্গতি হইয়াছে। অন্নপূর্ণ। আমি থাকিয়া যে-দুৰ্গতি ঠেকাইয়া রাখিতাম, সে-দুৰ্গতি একবার ঘটিয়া যাওয়াই ভালো । এখন আর তোর আমাকে কোনো দরকার হইবে না । অন্নপূর্ণ কহিলেন, “না, তুই আয়।” বিহারী ঘরে প্রবেশ করিল। এত সকালে মহেন্দ্ৰকে জাগ্ৰত দেখিয়া কহিল, “মহিনদা, আজ তোমার জীবনে এই বোধ হয় প্রথম সূর্যোদয় দেখিলে!” মহেন্দ্ৰ কহিল, “হা, বিহারী, আজ আমার জীবনে প্ৰথম সূর্যোদয়। বিহারীর বোধ হয় কাকীমার সঙ্গে কোনো পরামর্শ আছে— আমি যাই ।” বিহারী হাসিয়া কহিল, “ তোমাকেও নাহয় ক্যাবিনেটের মিনিস্টার করিয়া লওয়া গেল। তোমার কাছে আমি তো কখনো কিছু গোপন করি নাই— যদি আপত্তি না কর, আজও গোপন করিব না।” মহেন্দ্র। আমি আপত্তি করিব ! তবে আর দাবি করিতে পারি না বটে। তুমি যদি আমার কাছে কিছু গোপন না কর, তবে আমিও আমার প্রতি আবার শ্রদ্ধা করিতে পারিব। আজকাল মহেন্দ্রের সম্মুখে সকল কথা অসংকোচে বলা কঠিন। বিহারীর মুখ বাধিয়া আসিল, তবু সে জোর করিয়া বলিল, “বিনোদিনীকে বিবাহ করিব, এমন-একটা কথা উঠিয়াছিল, কাকীমার সঙ্গে সেই সম্বন্ধে আমি কথাবার্তা শেষ করিতে আসিয়াছি।” মূল কান্ত সংকুচিত হইয়া উঠিল। অন্নপূর্ণ চর্কিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “এ আবার কী কথা, ” মহেন্দ্র প্রবল শক্তি প্রয়োগ করিয়া সংকোচ দূর করিল। কহিল, “বিহারী, এ বিবাহের কোনো প্রয়োজন নাই ।” অন্নপূর্ণা কহিলেন, “এ বিবাহের প্রস্তাবে কি বিনোদিনীর কোনো যোগ আছে!” বিহারী কহিল, “কিছুমাত্র না।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “সে কি ইহাতে রাজি হইবে।” মহেন্দ্ৰ বলিয়া উঠিল, “বিনোদিনী কেন রাজি হইবে না, কাকীমা ? আমি জানি, সে একমনে বিহারীকে ভক্তি করে— এমন আশ্রয় সে কি ইচ্ছা করিয়া ছাড়িয়া দিতে পারে।” বিহারী কহিল, “মহিনদা, আমি বিনোদিনীকে বিবাহের প্রস্তাব করিয়াছি- সে লজার সঙ্গে তাহা শুনিয়া মহেন্দ্ৰ চুপ করিয়া রহিল। G8 ভালোয়-মন্দয় দুই-তিন দিন রাজলক্ষ্মীর কাটিয়া গেল। একদিন প্রাতে তাহার মুখ বেশ প্ৰসন্ন ও বেদনা সমস্ত হ্রাস হইল। সেই দিন তিনি মহেন্দ্ৰকে ডাকিয়া কহিলেন, “আর আমার বেশিক্ষণ সময় নাই— কিন্তু আমি বড়ো সুখে মরিলাম মহিন, আমার কোনো দুঃখ নাই। তুই যখন ছোটাে ছিলি, তখন