পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি Ο Σα দিতে সাহস হয় না। এ পর্যন্ত যাহা-কিছু ঘটিয়াছে, যাহা-কিছু সহ্য করিয়াছি, তাহার সমস্ত আবর্তন, সমস্ত আন্দোলন শান্ত করিতে না পারিলে জীবনের সমাপ্তির জন্য প্ৰস্তুত হইতে পারিব না। যদি সমস্ত অতীতকাল অনুকূল হইত, তবে সংসারে একমাত্র তোমার দ্বারাই আমার জীবন সম্পূর্ণ হইতে পারিত— এখন তোমা হইতে আমাকে বঞ্চিত হইতেই হইবে। এখন আর সুখের জন্য চেষ্টা বৃথা, এখন কেবল আস্তে আস্তে সমস্ত ভাঙচুর সারিয়া লইতে হইবে।” এই সময় অন্নপূর্ণ ঘরে ঢুকিতেই বিনোদিনী কহিল, “মা, আমাকে তোমার পায়ে স্থান দিতে হইবে। পাপিষ্ঠা বলিয়া আমাকে তুমি ঠেলিয়ে না।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “মা, চলো, আমার সঙ্গেই চলো।” অন্নপূর্ণ ও বিনোদিনীর কাশীতে যাইবার দিন কোনো সুযোগে বিহারী বিরলে বিনোদিনীর সহিত দেখা করিল। কহিল, “বোঠান, তোমার একটা কিছু চিহ্ন আমি কাছে রাখিতে চাই।” বিনোদিনী কহিল, “আমার এমন কী আছে, যাহা চিহ্নের মতো কাছে রাখিতে পার ?” বিহারী লজা ও সংকোচের সহিত কহিল, “ইংরেজের একটা প্ৰথা আছে, প্রিয়জনের একগুচ্ছ চুল স্মরণের জন্য রাখিয়া দেয়—যদি তুমি— ।” বিনোদিনী। ছিছি, কী ঘূণা। আমার চুল লইয়া কী করিবে। সেই অশুচি মৃতবস্তু আমার এমন কিছুই নহে, যাহা আমি তোমাকে দিতে পারি। আমি হতভাগিনী তোমার কাজে থাকিতে পারিব না— আমি এমন একটা-কিছু দিতে চাই, যাহা আমার হইয়া তোমার কাজ করিবে- বলো, তুমি লাইবে ? বিহারী কহিল, “লইব ।” তখন বিনোদিনী তাহার অঞ্চলের প্রান্ত খুলিয়া হাজার টাকার দুইখানি নোট বিহারীর হাতে দিল। বিহারী সুগভীর আবেগের সহিত স্থিরদৃষ্টিতে বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। খানিক বাদে বিহারী কহিল, “আমি কি তোমাকে কিছু দিতে পারিব না।” বিনোদিনী কহিল, “তোমার চিহ্ন আমার কাছে আছে, তাহা আমার অঙ্গের ভূষণ— তাহা কেহ কাড়িতে পরিবে না। আমার আর কিছু দরকার নাই।” বলিয়া সে নিজের হাতের সেই কাটা দাগ शिक्षेळ्न বিহারী আশ্চর্য হইয়া রহিল। বিনোদিনী কহিল, “তুমি জান না— এ! তোমারই আঘাত— এবং এ আঘাত তোমারই উপযুক্ত। ইহা এখন তুমিও ফিরাইতে পার না।” মাসিমার উপদেশসত্ত্বেও আশা বিনোদিনী সম্বন্ধে মনকে নিষ্কণ্টক করিতে পারে নাই। রাজলক্ষ্মীর সেবায় দুই জনে একত্রে কাজ করিয়াছে, কিন্তু আশা যখনই বিনোদিনীকে দেখিয়াছে তখনই তাহার বুকের মধ্যে ব্যথা লাগিয়াছে— মুখ দিয়া সহজে কথা বাহির হয় নাই, এবং হাসিবার চেষ্টা তাহাকে পীড়ন করিয়াছে। বিনোদিনীর নিকট হইতে সামান্য কোনো সেবা গ্ৰহণ করিতেও তাহার সমস্ত চিত্ত বিমুখ হইয়াছে। বিনোদিনীর সাজা পান। অনেক সময়ে শিষ্টতার খাতিরে তাহাকে গ্ৰহণ করিতে হইয়াছে, কিন্তু আড়ালে তাহা ফেলিয়া দিয়াছে। কিন্তু আজ যখন বিদায়কাল উপস্থিত হইল— মাসিম সংসার হইতে দ্বিতীয়বার চলিয়া যাইতেছেন বলিয়া আশার হৃদয় যখন অশ্রািজলে আন্দ্র হইয়া গেল, তখন সেইসঙ্গে বিনোদিনীর প্রতি তাহার করুণার উদয় হইল। যে একেবারে চলিয়া যাইতেছে তাহাকে মাপ করিতে পারে না, এমন কঠিন মন অল্পই আছে। আশা জানিত, বিনোদিনী মহেন্দ্ৰকে ভালোবাসে ; মহেন্দ্ৰকে ভালো না বাসিবেই বা কেন। মহেন্দ্ৰকে ভালোবাসা যে কিরূপ অনিবাৰ্য, আশা তাহা নিজের বড়ো দয়া হইল। বিনোদিনী মহেন্দ্ৰকে চিরদিনের জন্য ছাড়িয়া যাইতেছে, তাহার যে দুর্বিষহ দুঃখ, তাহা আশা অতিবড়ো শত্রুর জন্যও কামনা করিতে পারে না— মনে করিয়া তাহার চক্ষে জল আসিল ; এককালে সে বিনোদিনীকে ভালোবাসিয়াছিল- সেই ভালোবাসা তাহাকে স্পর্শ করিল। সে