পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

()་ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী গাহিয়া দিতে পারিতেন। কিন্তু কখনোই কোনো গান রীতিমত সম্পূর্ণ করিতেন না। বন্ধুরা বিরক্ত হইয়া বলিতেন, “তোমার এমন অসামান্য ক্ষমতা, কিন্তু গানগুলো শেষ কর না কেন ?” অক্ষয় ফস করিয়া সখা, শেষ করা কি ভালো ? তেল ফুরোবার আগেই আমি নিবিয়ে দেব আলো! এইরূপ ব্যবহারে সকলেই বিরক্ত হইয়া বলে, অক্ষয়কে কিছুতেই পারিয়া উঠা যায় না। পুরবালাও ত্যক্ত হইয়া বলিলেন, “ওস্তাদজি, থামো! আমার প্রস্তাব এই যে দিনের মধ্যে একটা সময় ঠিক করে যখন তোমার ঠাট্টা বন্ধ থাকবে- যখন তোমার সঙ্গে দুটো-একটা কাজের কথা হতে পারবে !” অক্ষয়। গরিবের ছেলে, স্ত্রীকে কথা বলতে দিতে ভরসা হয় না, পাছে খপ করে বাজুবন্দ চেয়ে বসে । আবার গান পাছে চেয়ে বসে আমার মন পাছে চোখে চোখে পড়ে বাধা আমি তাই তো তুলি নে আঁখি । পুরবালা। তবে যাও ! অক্ষয় । না না, রাগারগি না !! আচ্ছা, যা বল। তাই শুনব ! খাতায় নাম লিখিয়ে তোমার ঠাট্টানিবারণী সভার সভ্য হব ! তোমার সামনে কোনোরকমের বেয়াদবি করব না ! তা, কী কথা হচ্ছিল ! শ্যালীদের বিবাহ! উত্তম প্ৰস্তাব ! পুরবালা গভীর বিষন্ন হইয়া কহিল, “দেখো, এখন বাবা নেই। মা তোমারই মুখ চেয়ে আছেন। তোমারই কথা শুনে এখনো তিনি বেশি বয়স পর্যন্ত মেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। এখন যদি সৎপাত্র না জুটিয়ে দিতে পার তা হলে কী অন্যায় হবে ভেবে দেখো দেখি!” অক্ষয় দুর্লক্ষণ দেখিয়া পূর্বাপেক্ষা কথঞ্চিৎ গভীর হইয়া কহিলেন, “আমি তো তোমাকে বলেইছি তোমরা কোনো ভাবনা কোরো না। আমার শ্যালীপতিরা গোকুলে বাড়ছেন।” পুরবালা। গোকুলটি কোথায় ? অক্ষয় । যেখান থেকে এই হতভাগ্যকে তোমার গোষ্ঠে ভরতি করেছ। আমাদের সেই চিরকুমার-সভা। পুরবালা সন্দেহ প্ৰকাশ করিয়া কহিল, “প্রজাপতির সঙ্গে তাদের যে লড়াই!” অক্ষয়। দেবতার সঙ্গে লড়াই করে পারবে কেন ? তাকে কেবল চটিয়ে দেয় মাত্র। সেইজন্যে ভগবান প্ৰজাপতির বিশেষ ঝোক ঐ সভাটার উপরেই। সরাচাপা হাড়ির মধ্যে মাংস যেমন গুমে গুমে সিদ্ধ হতে থাকে- প্ৰতিজ্ঞার মধ্যে চাপা থেকে সভ্যগুলিও একেবারে হাড়ের কাছ পর্যন্ত নরম হয়ে উঠেছেন— দিব্যি বিবাহযোগ্য হয়ে এসেছেন— এখন পাতে দিলেই হয়। আমিও তো এক কালে ঐ সভার সভাপতি ছিলুম! আনন্দিতা পুরবালা বিজয়গর্বে ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার কিরকম দশটা অক্ষয়। সে আর কী বলব! প্ৰতিজ্ঞা ছিল স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ পর্যন্ত মুখে উচ্চারণ করব না, কিন্তু শেষকালে এমনি হল যে, মনে হত শ্ৰীকৃষ্ণের ষোলোশো গোপিনী যদি-বা সম্প্রতি দুপ্ৰাপ্য হন অন্তত মহাকালীর চৌষট্টি হাজার যোগিনীর সন্ধান পেলেও একবার পেট ভরে প্ৰেমালাপটা করে নিই- ঠিক সেই সময়টাতেই তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল আর কি ! পুরবালা। চৌষট্টি হাজারের শখ মিটাল ?