পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

( 8 Ο রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি আপনাদের চিরকুমার— কোনো প্ৰভেদ নেই। এখন আমার প্রস্তাবটা শুনুন।” চন্দ্রবাবু টেবিলের উপর কার্যবিবরণের খাতাটির প্রতি অত্যন্ত কুঁকিয়া পড়িয়া মন দিয়া শুনিতে লাগিলেন । অক্ষয় কহিলেন, “আমার কোনো মফস্বলের ধনী বন্ধু তার একটি সন্তানকে আপনাদের কুমারসভার সভ্য করতে ইচ্ছা করেছেন।” চন্দ্রবাবু বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “বাপ ছেলেটির বিবাহ দিতে চান না!” অক্ষয়। সে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন— বিবাহ সে কোনোক্রমেই করবে না, আমি তার জামিন রইলুম। তার দূরসম্পর্কের এক দাদাসুদ্ধ সভ্য হবেন। তার সম্বন্ধেও আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে— সুতরাং তার সন্দেহের বয়সটা আর নেই, সৌভাগ্যক্রমে সেটা আপনাদের সকলেরই আছে। অক্ষয়বাবুর প্রস্তাবে চিরকুমার-সভা প্ৰফুল্ল হইয়া উঠিল। সভাপতি কহিলেন, “সভ্যপদপ্রার্থীদের নাম ধাম বিবরণ—” অক্ষয় । অবশ্যই তাদের নাম ধাম বিবরণ একটা আছেই।--- সভাকে তার থেকে বঞ্চিত করতে পারা যাবে না— সভ্য যখন পাবেন তখন নাম ধাম বিবরণ –সুদ্ধই পাবেন । কিন্তু আপনাদের এই একতলার স্যাতসেঁতে ঘরটি স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকুল নয়; আপনাদের এই চিরকুমার ক'টির চিরত্ব যাতে হাস না হয় সে দিকে একটু দৃষ্টি রাখবেন। চন্দ্ৰবাবু কিঞ্চিৎ লজিত হইয়া খাতাটি নাকের কাছে তুলিয়া লইয়া বলিলেন, “অক্ষয়বাবু, আপনি জানেন তো আমাদের আয়-” অক্ষয়। আয়ের কথাটা আর প্রকাশ করবেন না, আমি জানি ও আলোচনাটা চিত্তপ্ৰফুল্লকর নয়। ভালো ঘরের বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছে। সেজন্যে আপনাদের ধনাধ্যক্ষকে স্মরণ করতে হবে না। চলন-না। আজই সমস্ত দেখিয়ে শুনিয়ে আনি । বিমর্ষ বিপিন-শ্ৰীশের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সভাপতিও প্ৰফুল্ল হইয়া উঠিয়া চুলের মধ্য দিয়া বার বার আঙুল বুলাইতে, বুলাইতে চুলগুলাকে অত্যন্ত অপরিষ্কার করিয়া তুলিলেন। কেবল পূর্ণ অত্যন্ত দমিয়া গেল। সে বলিল, “সভার স্থান-পরিবর্তনটা কিছু নয়।” অক্ষয় কহিলেন, “কেন, এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি করলেই কি আপনাদের চিরকৌমার্যের প্রদীপ হাওয়ায় নিবে যাবে ?” পূর্ণ। এ-ঘরটি তো আমাদের মন্দ বোধ হয় না ! অক্ষয়। মন্দ নয়। কিন্তু এর চেয়ে ভালো ঘর শহরে দুপ্রাপ্য হবে না। পূর্ণ। আমার তো মনে হয় বিলাসিতার দিকে মন না দিয়ে খানিকটা কষ্টসহিষ্ণুতা অভ্যাস করা ভালো । শ্ৰীশ কহিল, “ সেটা সভার অধিবেশনে না করে সভার বাইরে করা যাবে।” বিপিন কহিল, “একটা কাজে প্ৰবৃত্ত হলেই এত ক্লেশ সহ্য করবার অবসর পাওয়া যায় যে, অকারণে বলক্ষয় করা মৃঢ়তা।” অক্ষয়। বন্ধুগণ, আমার পরামর্শ শোনো, সভাঘরের অন্ধকার দিয়ে চিরকৌমার্য ব্ৰতের অন্ধকার আর বাড়িয়ে না। আলোক এবং বাতাস স্ত্রীলিঙ্গ নয়, অতএব সভার মধ্যে ও-দুটোকে প্রবেশ করতে বাধা দিয়ে না। আরো বিবেচনা করে দেখো, এ স্থানটি অত্যন্ত সরস, তোমাদের ব্রাতটি তদুপযুক্ত নয়। বাতিকের চর্চা করছি করো, কিন্তু বাতের চর্চা তোমাদের প্রতিজ্ঞার মধ্যে নয়। কী বল, শ্ৰীশবাবু বিপিনবাবুর কী মত ? দুই বন্ধু বলিল, “ঠিক কথা। ঘরটা একবার দেখেই আসা যাক-না।” পূর্ণ বিমর্ষ হইয়া নিরুত্তর রহিল। পাশের ঘরেও চাবি একবার ঠন করিল, কিন্তু অত্যন্ত অপ্ৰসন্ন সুরে ।