পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰজাপতির নির্বন্ধ ○ (? ○ চন্দ্ৰীমাধববাবুর দৃষ্টিশক্তি সে দিকেও যথেষ্ট প্রখর নহে । তিনি অন্য দিনের মতোই নিশ্চিন্ত নিৰ্ভরের ভাবে কহিলেন, “একবার খুঁজে দেখো তো ফেনি ।” নির্মলা কহিল, “তুমি কোথায় কী ফেল আমি কি খুঁজে বের করতে পারি ?” এতক্ষণে চন্দ্ৰবাবুর স্বভাবনিঃশঙ্ক মনে একটুখানি সন্দেহের সঞ্চার হইল ; স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন, “তুমিই তো পার নির্মল ! আমার সমস্ত ত্রুটিসম্বন্ধে এত ধৈৰ্য আর কার আছে ?” নির্মলার রুদ্ধ অভিমান চন্দ্ৰবাবুর মোহস্বরে অকস্মাৎ অশ্রুজলে বিগলিত হইবার উপক্ৰম করিল ; নিঃশব্দে সংবরণ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল । তাহাকে নিরুত্তর দেখিয়া চন্দ্ৰীমাধববাবু নির্মলার কাছে আসিলেন এবং যেমন করিয়া সন্দিগ্ধ মোহরটি চোখের খুব কাছে ধরিয়া পরীক্ষা করিতে হয় তেমনি কবিয়া নির্মলার মুখখানি দুই আঙুল দিয়া তুলিয়া ধরিয়া ক্ষণকাল দেখিলেন এবং গভীর মৃদু হাস্যে কহিলেন, “নিৰ্মল আকাশে একটুখানি মালিন্য দেখছি যেন ! কী হয়েছে বলে দেখি ।” নির্মলা জানিত চন্দ্ৰীমাধববাবু অনুমানের চেষ্টাও করিবেন না। যাহা স্পষ্ট প্রকাশমান নহে তাহা তিনি মনের মধ্যে স্থানও দিতেন না। তাহার নিজের চিত্ত যেমন শেষ পর্যন্ত স্বচ্ছ অন্যের নিকটও সেইরূপ একান্ত স্বচ্ছতা প্রত্যাশা করিতেন । নির্মলা ক্ষুব্ধ স্বরে কহিল, “এত দিন পরে আমাকে তোমাদের চিরকুমার-সভা থেকে বিদায় দিচ্ছ কেন ? আমি কী করেছি ?” চন্দ্ৰীমাধববাবু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “চিরকুমার-সভা থেকে তোমাকে বিদায় ? তোমার সঙ্গে সে সভার যোগ কী ?” নির্মলা। দরজার আড়ালে থাকলে বুঝি যোগ থাকে না ? অন্তত সেই যতটুকু যোগ তাই বা কেন যাবে ? চন্দ্ৰবাবু। নিৰ্মল, তুমি তো এ সভার কাজ করবে না— যারা কাজ করবে তাদের সুবিধার প্রতি লক্ষ রেখেই— নির্মলা । আমি কেন কাজ করব না ? তোমার ভাগ্নে না হয়ে ভাগী হয়ে জন্মেছি বলেই কি তোমাদের হিতকার্যে যোগ দিতে পারব না ? তবে আমাকে এত দিন শিক্ষা দিলে কেন ? নিজের হাতে আমার সমস্ত মনপ্ৰাণ জাগিয়ে দিয়ে শেষকালে কাজের পথ রোধ করে দাও কী বলে ? চন্দ্ৰীমাধববাবু এই উচ্ছাসের জন্য কিছুমাত্ৰ প্ৰস্তুত ছিলেন না ; তিনি যে নির্মলাকে নিজে কী ভাবে গড়িয়া তুলিয়াছিলেন তাহা নিজেই জানিতেন না। ধীরে ধীরে কহিলেন, “নিৰ্মল, এক সময়ে তো বিবাহ করে তোমাকে সংসারের কাজে প্ৰবৃত্ত হতে হবে।— চিরকুমার-সভার কাজ —” “বিবাহ আমি করব না।” “তবে কী করবে বলে ।” “ দেশের কাজে তোমার সাহায্য করব।” “আমরা তো সন্ন্যাস ব্ৰত গ্ৰহণ করতে প্ৰস্তুত হয়েছি।” “ভারতবর্ষে কি কেউ কখনো সন্ন্যাসিনী হয় নি ?” চন্দ্ৰীমাধববাবু স্তম্ভিত হইয়া হারানো বোতামটার কথা একেবারে ভুলিয়া গেলেন। নিরুত্তর হইয়া দাড়াইয়া রহিলেন । উৎসাহদীপ্তিতে মুখ আরক্তিম করিয়া নির্মলা কহিল, “মামা, যদি কোনো মেয়ে তোমাদের ব্ৰত গ্রহণের জন্যে অন্তরের সঙ্গে প্ৰস্তুত হয় তবে প্ৰকাশ্যভাবে তোমাদের সভার মধ্যে কেন তাকে গ্ৰহণ করবে না ? আমি তোমাদের কৌমাৰ্যসভার কেন সভ্য না হব ?” নিষ্কলুষচিত্ত চন্দ্ৰীমাধবের কাছে ইহার কোনো উত্তর ছিল না। তবু দ্বিধাকুষ্ঠিতভাবে বলিতে নির্মলা কথা শেষ না হইতেই বলিয়া উঠিল, “যারা সভ্য আছেন, যারা ভারতবর্ষের হিতব্ৰত