পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ ○○ রবীন্দ্র-রচনাবলী আরক্ত অধর কথা বলিতে গিয়া স্ফরিত হইতে থাকে, যে কোমল কপোল দুটি দেখিতে দেখিতে ভাবের আভাসে করুণাভ হইয়া উঠে, তাহার বিরুদ্ধে দাড় করাইতে পারে পুরুষের হাতে এমন কী ज्ञाछ् ? পথে আসিতে আসিতে দুই বন্ধুর মধ্যে কোনো কথাই হয় নাই। এখানে আসিয়া ঘরে প্রবেশ না। করিতেই যে শব্দগুলি শোনা গেল, অন্য কোনো দিন হইলে শ্ৰীশ তাহা লক্ষ্য করিত কি না। সন্দেহ— আজ তাহার কাছে কিছুই এড়াইল না। অনতিপূর্বেই ঘরের মধ্যে রমণীদল যে ছিল, ঘরে প্ৰবেশ করিয়াই সে তাহা বুঝিতে পারিল। অক্ষয় চলিয়া গেলে ঘরটি শ্ৰীশ ভালো করিয়া দেখিয়া লইল । টেবিলের মাঝখানে ফুলদানিতে ফুল সাজানো । সেটা চকিতে তাহাকে একটু যেন বিচলিত করিল। তাহার একটা কারণ শ্ৰীশ অত্যন্ত ফুল ভালোবাসে, তাহার আর-একটা কারণ শ্ৰীশ কল্পনাচক্ষে দেখিতে পাইল— অনতিকাল পূর্বেই যাহাদের সুনিপুণ দক্ষিণ হস্ত এই ফুলগুলি সাজাইয়াছে তাহারাই এখনই ত্ৰস্তপদে ঘর হইতে পলাইয়া গেল । বিপিন ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “যা বল ভাই, এ ঘরটি চিরকুমার-সভার উপযুক্ত নয়।” হঠাৎ মৌনভঙ্গে শ্ৰীশ চকিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “কেন নয় ?” বিপিন কহিল, “ঘরের সজাগুলি তোমার নবীন সন্ন্যাসীদের পক্ষেও যেন বেশি বোধ হচ্ছে।” শ্ৰীশ। আমার সন্ন্যাসধর্মের পক্ষে বেশি কিছুই হতে পারে না। বিপিন। কেবল নারী ছাড়া ! শ্ৰীশ কহিল, “হা, ঐ একটি মাত্র!”— লেখকের অনুমানমাত্র হইতে পারে, কিন্তু অন্যদিনের মতো কথাটায় তেমন জোর পৌছিল না । বিপিন কহিল, “ দেয়ালের ছবি এবং অন্যান্য পাচরকমে এ ঘরটিতে সেই নারীজাতির অনেকগুলি পরিচয় পাওয়া যায় যেন।” শ্ৰীশ। সংসারে নারীজাতির পরিচয় তো সর্বত্রই আছে। বিপিন। তা তো বটেই। কবিদের কথা যদি বিশ্বাস করা যায় তা হলে চাদে ফুলে লতায় পাতায় কোনােখানেই নারীজাতির পরিচয় থেকে হতভাগ্য পুরুষমানুষের নিস্কৃতি পাবার জো নেই। শ্ৰীশ হাসিয়া কহিল, “ কেবল ভেবেছিলুম, চন্দ্ৰবাবুর বাসার সেই একতলার ঘরটিতে রমণীর কোনাে সংস্রব ছিল না। আজ সে ভ্রমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। নাঃ, ওরা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে।” বিপিন। বেচারা চিরকুমার কটির জন্যে একটা কোণও ফাঁকা রাখে নি। সভা করবার জায়গা পাওয়াই দায় । শ্ৰীশ “এই দেখে-না” বলিয়া কোণের একটা টিপাই হইতে গােটাদুয়েক চুলের কাটা তুলিয়া দেখাইল । বিপিন কাটা দুটি লইয়া পর্যবেক্ষণ করিয়া কহিল, “ওহে ভাই, এ স্থানটা তাে কুমারদের পক্ষে নিষ্কণ্টক নয়।” শ্ৰীশ। ফুলও আছে, কাটাও আছে। বিপিন। সেইটেই তো বিপদ। কেবল কাটা থাকলে এড়িয়ে চলা যায়। শ্ৰীশ অপর কোণের ছােটাে বইয়ের শেলফ হইতে বইগুলি তুলিয়া দেখিতে লাগিল। কতকগুলি নভেল, কতকগুলি ইংরাজি কাব্যসংগ্ৰহ। প্যালগ্রেভের গীতিকাব্যের স্বর্ণভাণ্ডার খুলিয়া দেখিল, মার্জিনে মেয়েলি অক্ষরে নােট লেখা— তখন গােড়ার পাতাটা উলটাইয়া দেখিল। দেখিয়া একটু বিপিন পড়িয়া কহিল, “নৃপবালা! আমার বিশ্বাস নামটি পুরুষমানুষের নয়। কী বােধ কর।” শ্ৰীশ। আমারও সেই বিশ্বাস। এ নামটিও অন্যজাতীয়ের বলে ঠেকছে হে! বলিয়া আর-একটা বই দেখাইল ।