পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মশক্তি V\S ধর্মের নামে প্রচলিত আছে, তাহাদেরও অধিকাংশ আজকাল ক্রমশ দূষিত হইয়া কেবল যে লোকশিক্ষার অযোগ্য হইয়াছে তাহা নহে, কুশিক্ষারও আকর হইয়া উঠিয়াছে। উপেক্ষিত শস্যক্ষেত্রে শস্যও হইতেছে না, কঁাটাগাছও জন্মিতেছে। এমন অবস্থায় কুৎসিত আমোদের উপলক্ষ এই মেলাগুলিকে যদি আমরা উদ্ধার না করি, তবে স্বদেশের কাছে ধর্মের কাছে অপরাধী হইব । এ কথা শুনিবা মাত্ৰ যেন আমাদের মধ্যে হঠাৎ একদল লোক অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া না ওঠেন- এ কথা না বলিয়া বসেন যে, এই মেলাগুলির প্রতি গবৰ্মেন্টের অত্যন্ত ঔদাসীন্য দেখা যাইতেছে— অতএব আমরা সভা করিয়া কাগজে লিখিয়া প্রবলবেগে গবমেন্টের সাকো নাড়াইতে শুরু করিয়া দিই— মেলাগুলির মাথার উপরে দলবল-আইনকানুনসমেত পুলিস কমিশনার ভাঙিয়া পড়ুক— সমস্ত একদমে পরিষ্কার হইয়া যাক। ধৈর্য ধরিতে হইবে।— বিলম্ব হয়, বাধা পাই, সেও স্বীকার, কিন্তু এ সমস্ত আমাদের নিজের কাজ। চিরকাল ঘরের লক্ষ্মী আমাদের ঘর নিকাইয়া পারে বটে, কিন্তু লক্ষ্মীর সম্মার্জনীতে পবিত্ৰ করিয়া তোলে, এ কথা যেন আমরা না ভুলি। একটি দৃষ্টান্ত দিলাম মাত্র, এবং এই উপলক্ষটিকে নিয়মে বাধিয়া আয়ত্তে আনিয়া কী করিয়া যে একটা দেশব্যাপী মঙ্গলব্যাপারে পরিণত করা যাইতে পারে, তাহারই আভাস দেওয়া গেল । যাহারা রাজদ্বারে ভিক্ষাবৃত্তিকে দেশের মঙ্গল-ব্যাপার বলিয়া গণ্যই করেন না তাহাদিগকে অন্য পক্ষে “ পেসিমিস্ট” অর্থাৎ আশাহীনের দল নাম দিয়াছেন। অর্থাৎ রাজার কাছে কোনো আশা নাই বলিয়া আমরা যতটা হতাশ্বাস হইয়া পড়িয়াছি, ততটা নৈরাশ্যকে তাহারা অমূলক বলিয়া জ্ঞান করেন। খেদাইতেছেন বলিয়াই যে অগত্যা আত্মনির্ভরকে শ্রেয়োজ্ঞান করিতেছি, কোনোদিনই আমি এরূপ দুর্লভদ্ৰাক্ষাগুচ্ছলুব্ধ হতভাগ্য শৃগালের সাস্তুনাকে আশ্রয় করি নাই। আমি এই কথাই বলি, পরের প্ৰসাদভিক্ষাই যথার্থ “ পেসিমিস্ট” আশাহীন দীনের লক্ষণ। গলার কাছা না লইলে আমাদের গতি নাই, এ কথা আমি কোনোমতেই বলিব না- আমি স্বদেশকে বিশ্বাস করি, আমি আত্মশক্তিকে সম্মান করি। আমি নিশ্চয় জানি যে, যে উপায়েই হউক, আমরা নিজের মধ্যে একটা স্বদেশীয় স্বজাতীয় ঐক্য উপলব্ধি করিয়া আজ যে সার্থকতালাভের জন্য উৎসুক হইয়াছি, তাহার ভিত্তি যদি পরের পরিবর্তনশীল প্ৰসন্নতার উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়, যদি তাহা বিশেষভাবে ভারতবর্ষের স্বকীয় না হয়, তবে তাহা পুনঃপুনই ব্যৰ্থ হইতে থাকিবে। অতএব ভারতবর্ষের যথার্থ পথটি যে কী, আমাদিগকে চারি দিক হইতেই তাহার সন্ধান করিতে হইবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়সম্বন্ধস্থাপনই চিরকাল ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান চেষ্টা ছিল। দূর আত্মীয়ের সঙ্গেও সম্বন্ধ রাখিতে হইবে, সন্তানেরা বয়স্ক হইলেও সম্বন্ধ শিথিল হইবে না, গ্রামস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গেও বর্ণ ও অবস্থা-নির্বিচারে যথাযোগ্য আত্মীয়সম্বন্ধ রক্ষা করিতে হইবে ; গুরু-পুরোহিত, অতিথি-ভিক্ষুক, ভূস্বামী-প্রজাভূত্য সকলের সঙ্গেই যথােচিত সম্বন্ধ বাধা রহিয়াছে। এগুলি কেবলমাত্র শাস্ত্ৰবিহিত নৈতিক সম্বন্ধ নহে— এগুলি হৃদয়ের সম্বন্ধ। ইহারা কেহ বা পিতৃস্থানীয়, কেহ বা পুত্ৰস্থানীয়, কেহ বা ভাই, কেহ বা বয়স্য। আমরা যে-কোনো মানুষের যথার্থ সংস্রবে। আসি, তাহার সঙ্গে একটা সম্বন্ধ নির্ণয় করিয়া বসি । এইজন্য কোনো অবস্থায় মানুষকে আমরা আমাদের কাৰ্যসাধনের কল বা কলের অঙ্গ বলিয়া মনে করিতে পারি না। ইহার ভালো মন্দ দুই দিকই থাকিতে পারে, কিন্তু ইহা আমাদের দেশীয়, এমন-কি, তদপেক্ষাও বড়ো, ইহা প্ৰাচ্য। জাপান-যুদ্ধব্যাপার হইতে আমার এই কথার দৃষ্টান্ত উজ্জ্বল হইবে। যুদ্ধব্যাপারটি একটা কলের জিনিস সন্দেহ নাই— সৈন্যদিগকে কলের মতো হইয়া উঠিতে হয় এবং কলের মতোই চলিতে হয়। কিন্তু তৎসত্ত্বেও জাপানের প্রত্যেক সৈন্য সেই কলকে ছাড়াইয়া উঠিয়াছে, তাহারা অন্ধ জড়বৎ নহে, রক্তেগন্মাদগ্ৰস্ত পশুবৎও নহে; তাহারা প্রত্যেকে মিকাডোর সহিত এবং সেই সূত্রে স্বদেশের সহিত