পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী 8 (9 ص দিবে, আমাদের কর্তব্য কেবল এই যে, ভিক্ষার অংশ মনের মতো না হইলেই আমরা চীৎকার করিতে থাকিব ? কদাচি নহে, কদাচি নাহে ! স্বদেশের ভার আমরা প্ৰত্যেকেই এবং প্রতিদিনই গ্রহণ করিব- তাহাতে আমাদের গৌরব, আমাদের ধর্ম। এইবার সময় আসিয়াছে। যখন আমাদের সমাজ একটি সুবৃহৎ স্বদেশী সমাজ হইয়া উঠিবে। সময় আসিয়াছে। যখন প্রত্যেকে জানিবে আমি একক নহি— আমি ক্ষুদ্র হইলেও আমাকে কেহ ত্যাগ করিতে পরিবে না এবং ক্ষুদ্রতমকেও আমি ত্যাগ করিতে পারিব না । তর্ক এই উঠিতে পারে যে, ব্যক্তিগত হৃদয়ের সম্বন্ধ দ্বারা খুব বড়ো জায়গা ব্যাপ্ত করা সম্ভবপর হইতে পারে না । একটা ছোটো পল্লীকেই আমরা প্ৰত্যক্ষভাবে আপনার করিয়া লইয়া তাহার সমস্ত দায়িত্ব স্বীকার করিতে পারি— কিন্তু পরিধি বিস্তীর্ণ করিলেই কলের দরকার হয়— দেশকে আমরা কখনোই পল্লীর মতো করিয়া দেখিতে পারি না- এইজন্য অব্যবহিতভাবে দেশের কাজ করা যায় না, কলের সাহায্যে করিতে হয়। এই কল-জিনিসটা আমাদের ছিল না, সুতরাং ইহা বিদেশ হইতে আনাইতে হইবে এবং কারখানা—ঘরের সমস্ত সাজসরঞ্জাম-আইনকানুন গ্ৰহণ না করিলে কল চলিবে 'en'] || কথাটা অসংগত নহে। কল পাতিতেই হইবে। এবং কলের নিয়ম যে-দেশী হউক না কেন, তাহা মানিয়া না লইলে সমস্তই ব্যর্থ হইবে। এ কথা সম্পৰ্ণ স্বীকার করিয়াও বলিতে হইবে, শুধু কলে ভারতবর্ষ চলিবে না— যেখানে আমাদের ব্যক্তিগত হৃদয়ের সম্বন্ধ আমরা প্ৰত্যক্ষভাবে অনুভব না। করিব, সেখানে আমাদের সমস্ত প্ৰকৃতিকে আকর্ষণ করিতে পরিবে না। ইহাকে ভালোই বল আর মন্দই বল, গালিই দাও। আর প্রশংসাই কর, ইহা সত্য । অতএব আমরা যে-কোনো কাজে সফলতা লাভ করিতে চাই, এই কথাটি আমাদিগকে স্মরণ করিতে হইবে। স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন । তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব। তাহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে । পূর্বে যখন রাষ্ট্র সমাজের সহিত অবিচ্ছিন্ন ছিল, তখন রাজারই এই পদ ছিল। এখন রাজা সমাজের বাহিরে যাওয়াতে সমাজ শীর্ষহীন হইয়াছে। সুতরাং দীর্ঘকাল হইতে বাধ্য হইয়া পল্লীসমাজই খণ্ড খণ্ড ভাবে আপনার কােজ আপনি সম্পন্ন করিয়াছে— স্বদেশী সমাজ তেমন ঘনিষ্ঠভাবে গড়িয়া বাড়িয়া উঠিতে পারে নাই। আমাদের কর্তব্য পালিত হইয়াছে বটে এবং হইয়াছে বলিয়াই আজও আমাদের মনুষ্যত্ব আছে- কিন্তু আমাদের কর্তব্য ক্ষুদ্র হইয়াছে এবং ক্ষুদ্র হওয়াতে আমাদের চরিত্রে সংকীর্ণতা প্রবেশ করিয়াছে। সংকীর্ণ সম্পূর্ণতার মধ্যে চিরদিন বদ্ধ হইয়া থাকা স্বাস্থ্যকর নহে, এইজন্য যাহা ভাঙিয়াছে তাহার জন্য আমরা শোক করিব না— যাহা গড়িতে হইবে তাহার প্রতি আমাদের সমস্ত চিত্তকে প্রয়োগ করিব। আজকাল জড়ভাবে, যথেচ্ছাক্রমে, দায়ে পড়িয়া, যাহা ঘটিয়া উঠিতেছে। তাহাঁই ঘটিতে দেওয়া কখনোই আমাদের শ্রেয়স্কর হইতে পারে না। এক্ষণে আমাদের সমাজপতি চাই। তাহার সঙ্গে তাহার পার্ষদসভা থাকিবে, কিন্তু তিনি প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সমাজের অধিপতি হইবেন । আমাদের প্রত্যেকের নিকটে তাহারই মধ্যে সমাজের একতা সপ্ৰমাণ হইবে । আজ যদি করিতে হইবে, তাহা ভাবিয়া তাহার মাথা ঘুরিয়া যাইবে। অধিকাংশ লোকেই আপনার কর্তব্য উদ্ভাবন করিয়া চলে না বলিয়াই রক্ষা। এমন স্থলে ব্যক্তিগত চেষ্টাগুলিকে নির্দিষ্ট পথে আকর্ষণ করিয়া লইবার জন্য একটি কেন্দ্ৰ থাকা চাই। আমাদের সমাজের কোনো দল সেই কেন্দ্রের স্থল অধিকার করিতে পরিবে না। আমাদের দেশে অনেক দলকেই দেখি, প্ৰথম উৎসাহের ধাক্কায় তাহারা যদি বা অনেকগুলি ফুল ফুটাইয়া তোলে, কিন্তু শেষকালে ফল ধরাইতে পারে না। তাহার বিবিধ কারণ