পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○ ミ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী একটা যজ্ঞে যেখানে বন্ধুবান্ধবকে নিমন্ত্রণ করা হইয়াছে, সেখানে যদি একটা ছাগশিশুকে সাদরে আহবান করিবার জন্য মাল্যসিন্দূর-হস্তে লোক আসে, এবং এই সাদর ব্যবহারে ছাগের একান্ত সংকোচ দেখিয়া তাহাকে বলা হয়- এ কী আশ্চৰ্য, এতবড়ো মহৎ যজ্ঞে যোগ দিতে তোমার আপত্তি ! হায়, অন্যের যোগ দেওয়া এবং তাহার যোগ দেওয়াতে যে কত প্ৰভেদ তাহা যে সে এক মুহুৰ্তও ভুলিতে পারিতেছে না। যজ্ঞে আত্মবিসর্জন দেওয়ার অধিকার ছাড়া আর কোনাে অধিকারই যে তাহার নাই। কিন্তু ছাগশিশুর এই বেদনা যজ্ঞকর্তার পক্ষে বোঝা কঠিন, ছাগ এতই অকিঞ্চিৎকার। ইস্পীরিয়ালতন্ত্র বিপ্লব নিবারণ করবেন, আমাদের অধিকার প্রাণদান করা ; উষ্ণপ্ৰধান উপনিবেশে ফসল উৎপাদন করিবেন, আমাদের অধিকার সস্তায় মজুর জোগান দেওয়া। বড়োয়-ছোটোয় মিলিয়া যজ্ঞ করিবার এই নিয়ম। কিন্তু ইহা লইয়া উত্তেজিত হইবার কোনো প্রয়োজন নাই। সক্ষম এবং অক্ষমের হিসাব যখন এক খাতায় রাখা হয় তখন জমার অঙ্কের এবং খরচের অঙ্কের ভাগ এমনিভাবে হওয়াই স্বাভাবিক এবং যাহা স্বাভাবিক তাহার উপর চোখ রাঙানো চলে না, চােখের জল ফেলাও বৃথা। স্বভাবকে স্বীকার করিয়াই কাজ করিতে হইবে। ভাবিয়া দেখো, আমরা যখন ইংরেজকে বলিতেছি “তুমি সাধারণ মনুষ্যস্বভাবের চেয়ে উপরে ওঠে— তুমি স্বজাতির স্বার্থকে ভারতবর্ষের মঙ্গলের কাছে খর্ব করো তখন ইংরেজ যদি জবাব দেয়, “আচ্ছা, তোমার মুখে ধর্মোপদেশ আমরা পরে শুনিব, আপাতত তোমার প্রতি আমার বক্তব্য এই যে, সাধারণ মনুষ্যস্বভাবের যে নিম্নাতন কোঠায় আমি আছি সেই কোঠায় তুমিও এসো, তাহার উপরে উঠিয়া কাজ নাই-স্বজাতির স্বার্থকে তুমি নিজের স্বার্থ করো— স্বজাতির উন্নতির জন্য তুমি প্ৰাণ দিতে না পার অন্তত আরাম বলো অর্থ বলো কিছু একটা দাও। তোমাদের দেশের জন্য আমরাই সমস্ত করিব, আর তোমরা নিজে কিছুই করিবে না।!” এ কথা বলিলে তাহার কী উত্তর আছে ? বস্তুত আমরা কে কী দিতেছি, কে কী করিতেছি! আর-কিছু না করিয়া যদি দেশের খবর লইতাম, তাহাও বুঝি— আলস্যপূর্বক তাহাও লই না। দেশের ইতিহাস ইংরেজ সম্বন্ধে বলো, ভূতত্ত্ব বলো, নৃতত্ত্ব বলো, নিজের চেষ্টার দ্বারা আমরা কিছুই সংগ্ৰহ করিতে চাই না । স্বদেশের প্রতি এমন একান্ত ঔৎসুক্যহীনতাসত্ত্বেও আমাদের দেশের প্রতি কর্তব্যপালন সম্বন্ধে বিদেশীকে আমরা উচ্চতম কর্তব্যনীতির উপদেশ দিতে কুষ্ঠিত হই না । সে উপদেশ কোনোদিনই কোনো কাজে লাগিতে পারে না । কারণ যে ব্যক্তি কাজ করিতেছে তাহার দায়িত্ব আছে— যে ব্যক্তি কাজ করিতেছে না, কথা বলিতেছে, তাহার দায়িত্ব নাই— এই উভয় পক্ষের মধ্যে কখনোই যথার্থ আদানপ্ৰদান চলিতে পারে না । এক পক্ষে টাকা অনেক আছে, অন্য পক্ষে শুদ্ধমাত্র চেকবইখানি আছে, এমন স্থলে সে ফাকা চেক ভাঙানো চলে না । ভিক্ষার স্বরূপে এক-আধবার দৈবাৎ চলে, কিন্তু দাবি-স্বরূপে বরাবর চলে না— ইহাতে পেটের জ্বালায় মধ্যে মধ্যে রাগ হয় বটে, এক-একবার মনে হয় আমাকে অপমান করিয়া ফিরাইয়া দিল— কিন্তু সে অপমান সে ব্যর্থতা তারস্বরেই হউক আর নিঃশব্দেই হউক গলাধঃকরণপূর্বক সম্পূর্ণ পরিপাক করা ছাড়া আর গতি নাই | এরূপ প্রতিদিনই দেখা যাইতেছে । আমরা বিরাট সভাও করি, খবরের কাগজেও লিখি, আবার যাহা হজম করা বড়ো কঠিন তাহা নিঃশেষে পরিপাকও করিয়া থাকি। পূর্বের দিনে যাহা একেবারে অসহ্য বলিয়া ঘোষণা করিয়া বেড়াই, পরের দিনে তাহার জন্য বৈদ্য ডাকিতে হয় না । আশা করি, আমাকে সকলে বলিবেন, তুমি অত্যন্ত পুরাতন কথা বলিতেছ, নিজের কাজ নিজেকে করিতে হইবে, নিজের লজ্জা নিজেকে মোচন করিতে হইবে, নিজের সম্পদ নিজেকে অর্জন করিতে হইবে, নিজের সম্মান নিজেকে উদ্ধার করিতে হইবে, এ কথার নূতনত্ব কোথায় । পুরাতন কথা বলিতেছি এমন অপবাদ আমি মাথায় করিয়া লইব । আমি নুতন-উদ্ভাবনা-বর্জিত এ কলঙ্ক অঙ্গের