পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

We we O রবীন্দ্র-রচনাবলী প্ৰতি আসক্তি না রাখিয়া কর্ম করিবে। ভিক্ষার অগৌরব এই যে, ফললাভ হইলেও নিজের শক্তি নিজে খাটাইবার যে সার্থকতা তাহা হইতে বঞ্চিত হইতে হয়। যাহা হউক, ইহা দেখা যাইতেছে যে, সকল দিক দিয়াই আমরা নিজের স্বাধীন শক্তির গৌরব অনুভব করিবার একটা উদ্যম অস্তরের মধ্যে অনুভব করিতেছি- সাহিত্য হইতে আরম্ভ করিয়া পলিটিকস পর্যন্ত কোথাও ইহার বিচ্ছেদ নাই। ইহার একটা ফল এই দেখিতেছি, পূর্বে ইংরেজি শিক্ষা আমাদের দেশে প্রাচীন নবীন, শিক্ষিত অশিক্ষিত, উচ্চ নীচ, ছাত্র ও সংসারীর মধ্যে যে একটা বিচ্ছেদের সৃষ্টি করিয়াছিল এখন তাহার উলটা চেষ্টা করিতেছি। মধ্যকালের এই বিচ্ছিন্নতাই পরিণামের মিলনকে যথার্থভাবে সম্পূৰ্ণ করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই । ছাত্ৰাদিগকেও আপন করিয়াছে। একদিন যেখানে বিপক্ষের দুৰ্ভেদ্য দুর্গ ছিল সেখান হইতেও বঙ্গের বিজয়িনী বাণী স্বেচ্ছাসমাগত সেবকদের অর্ঘ্যলাভ করিতেছেন। পূর্বে এমন দিন ছিল যখন ইংরেজি পাঠশালা হইতে আমাদের একেবারে ছুটি ছিল না। বাড়ি আসিতাম, সেখানেও পাঠশালা পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিয়া আসিত। বন্ধুকেও সম্ভাষণ করিতাম ইংরেজিতে, পিতাকেও পত্ৰ লিখিতাম ইংরেজিতে, প্ৰাণের কথা বলিতাম ইংরেজি কাব্যে, দেশের লোককে সভায় আহবান করিতাম ইংরেজি বক্তৃতায়। আজ যখন সেই পাঠশালা হইতে, একেবারে না হউক, ক্ষণে ক্ষণে ছুটি পাইয়া থাকি তখন সেই ছুটির সময়টাতে আনন্দ করিব কোথায় ? মাতার অন্তঃপুরে নহে কি ? দিনের পড়া তো শেষ হইল, তার পরে ক্রিকেট খেলাতেও নাহয় রণজিৎ হইয়া উঠিলাম। তার পরে ? তার পরে গৃহবাতায়ন হইতে মাতার স্বহস্তেজালিত সন্ধ্যাদীপটি কি চোখে পড়িবে না ? যদি পড়ে, তবে কি অবজ্ঞা করিয়া বলিব ‘ওটা মাটির প্রদীপ’ ? ঐ মাটির প্রদীপের পশ্চাতে কি মাতার গৌরব নাই ? যদি মাটির প্রদীপই হয় তো সে দোষ করা ? মাতার কক্ষে সোনার প্রদীপ গড়িয়া দিতে কে বাধা দিয়াছে ? যেমনই হউক-না কেন, মাটিই হউক আর সোনাই হউক, যখন আনন্দের দিন আসিবে তখন ঐখানেই আমাদের উৎসব, আর যখন দুঃখের অন্ধকার ঘনাইয়া আসে তখন রাজপথে দাড়াইয়া চোখের জল ফেলা যায় না- তখন ঐ গৃহ ছাড়া আর গতি নাই। আজ এখানে আমরা সেই পাঠশালার ফেরত আসিয়াছি। আজ সাহিত্য-পরিষৎ আমাদিগকে যেখানে আহবান করিয়াছেন তাহা কলেজ-ক্লাস হইতে দূরে, তাহা ক্রিকেট-ময়দানেরও সীমান্তরে, সেখানে আমাদের দরিদ্র জননীর সন্ধ্যাবেলাকার মাটির প্রদীপটি জ্বলিতেছে। সেখানে আয়োজন খুব বেশি নাই- কিন্তু, তোমরা এক সময়ে তাহার কাছে শ্রান্তদেহে ফিরিয়া আসিবে বলিয়া সমস্ত দিন যিনি পথ তাকাইয়া বসিয়া আছেন, আয়োজনে কি তাহার গৌরব প্রমাণ হইবে ? তিনি এইমাত্র জানেন যে তোমরাই তাহার একমাত্র গৌরব এবং আমরা জানি তোমাদের একমাত্র গৌরব তাহার চরণের ধূলি, ভিক্ষালব্ধ রাজপ্ৰসাদ নহে। পরীক্ষাশালা হইতে আজ তোমরা সদ্য আসিতেছ, সেইজন্য ঘরের কথা আজই তোমাদিগকে স্মরণ করাইবার যথার্থ অবকাশ উপস্থিত হইয়াছে— সেইজন্যই বঙ্গবাণীর হইয়া বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ কলেজের বাহিরে যে-দেশ পড়িয়া আছে তাহার মহত্ত্ব একেবারে ভুলিলে চলিবে না। কলেজের শিক্ষার সঙ্গে দেশের একটা স্বাভাবিক যোগ স্থাপন করিতে হইবে। অন্য দেশে সে যোগ চেষ্টা করিয়া স্থাপন করিতে হয় না। সে-সকল দেশের কলেজ দেশেরই একটা অঙ্গ— সমস্ত দেশের আভ্যন্তরিক প্রকৃতি তাহাকে গঠিত করিয়া তোলাতে দেশের সহিত কোথাও তাহার কোনো বিচ্ছেদের রেখা নাই। আমাদের কলেজের সহিত দেশের ভেদচিহ্নহীন সুন্দর ঐক্য স্থাপিত হয় নাই। যেরূপ দেখা যাইতেছে, বিদ্যাশিক্ষা কালক্রমে কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ আয়ত্তাধীন