পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী 8 ما ما সত্যমিথ্যা নিশ্চয় জানি না, কিন্তু মনে হয়, এখনকার ছেলেদের চেয়ে তখন আমরা অনেক বেশি। ছেলেমানুষ ছিলাম। সেটা ভালো কি মন্দ তাহার দুই পক্ষেই বলিবার কথা আছে— কিন্তু, ছেলেমানুষ থাকিবার একটা গুণ ছিল যে, আমাদের আশার অন্ত ছিল না, ভবিষ্যতের দিকে কী চোখে যে চাহিতাম, কিছুই অসাধ্য এবং অসম্ভব বলিয়া মনে হইত না। তখন আমরা এমন-সকল সভা করিয়াছিলাম, এমন-সকল দল বাধিয়াছিলাম, এমন-সকল সংকল্পে বদ্ধ হইয়াছিলাম যাহা এখনকার দিনে তোমরা শুনিলে নিশ্চয় হাস্যসংবরণ করিতে পরিবে না এবং আমাদের সাহিত্যে কোনো কোনো স্থলে আমাদের সেদিনকার চিত্র হাস্যরসরঞ্জিত তুলিকায় চিত্রিত হইয়াছে বলিয়া আমার বিশ্বাস। কিন্তু, সব কথা যদি খুলিয়া বলি। তবে তোমরা এই মনে করিয়া বিস্মিত হইবে যে, আমাদের সেকালে আমরা, বালকেরা, সকলেই যে একবয়সী ছিলাম তাহা নহে, আমাদের মধ্যে পৰ্ব্বককেশের অভাব ছিল না এবং তাঁহাদের আশা ও উৎসাহ আমাদের চেয়ে যে কিছুমাত্র অল্প ছিল, তাহাও বলিতে পারি না। তখন আমরা নবীনে-প্রবীণে মিলিয়া ভয়-লজা-নৈরাশ্য কেমন নিঃশেষে বিসর্জন দিয়াছিলাম, তাহা আজও ভুলিতে পারিব না। সেদিনের চেয়ে নিঃসন্দেহেই আজ আমরা অনেক বিষয়ে অগ্রসর হইয়াছি, কিন্তু আজ আকাশে আশার আলোক যেন স্নান এবং পথিকের হস্তে আনন্দের পাথেয় যেন অপ্রচুর। কেন এমনটা ঘটিল। তাহার জবাবদিহি এখনকার কালের নহে, আমাদিগকেই তাহার কৈফিয়ত দিতে হইবে। যে আশার সম্বল লইয়া যাত্রা আরম্ভ করিয়াছিলাম তাহা পথের মধ্যে কোনখানে উড়াইয়া-পুড়াইয়া দিয়া আজ এমন রিক্ত হইয়া বসিয়া আছি। অপরিমিত আশা-উৎসাহ আমাদের অল্পবয়সের প্রথম সম্বল ; কর্মের পথে যাত্ৰা করিবার আরম্ভকালে বিধাতৃমাতা এইটে আমাদের অঞ্চল।প্ৰান্তে বাধিয়া আশীর্বাদ করিয়া প্রেরণ করেন। কিন্তু অর্থ যেমন খাদ্য নহে, তাহা ভাঙাইয়া। তবে খাইতে হয়, তেমনি আশা-উৎসাহমাত্র আমাদিগকে সার্থক করে না, তাহাকে বিশেষ কাজে খাটাইয়া। তবে ফললাভ করি। সে কথা ভুলিয়া আমরা বরাবর ঐ আশা-উৎসাহেই পেট ভরাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম। শিশুরা শুইয়া শুইয়াই হাত-পা ছুড়িতে থাকে- তাহাদের সেই শরীরসঞ্চালনের কোনো লক্ষ্য নাই। প্রথমাবস্থায় শক্তির এইরূপ অনির্দিষ্ট বিক্ষেপের একটা অর্থ আছে— কিন্তু, সেই অকারণ হাত-পা-ছোড়া ক্ৰমে যদি তাহাকে সকারণ চেষ্টার জন্য প্ৰস্তুত করিয়া না তোলে। তবে তাহা ব্যাধি বলিয়াই গণ্য হইবে । আমাদেরও অল্পবয়সে উদ্যমগুলি প্ৰথমে কেবলমাত্র নিজের আনন্দেই বিক্ষিপ্তভাবে উদামভাবে চারি দিকে সঞ্চালিত হইতেছিল— তখনকার পক্ষে তাহা অদ্ভুত ছিল না, তাহারা বিদ্রুপের বিষয় ছিল না। কিন্তু ক্ৰমেই যখন দিন যাইতে লাগিল এবং আমরা কেবল পড়িয়া পডিয়া অঙ্গসঞ্চালন করিতে লাগিলাম। কিন্তু চলিতে লাগিলাম না, শরীরের আক্ষেপবিক্ষেপকেই অগ্রসর হইবার উপায় বলিয়া কল্পনা করিতে লাগিলাম, তখন আর আনন্দের কারণ রহিল না— এবং এক সময়ে যাহা আবশ্যক ছিল অন্য সময়ের পক্ষে তাঁহাই দুশ্চিন্তার বিষয় হইয়া উঠিল। আমাদের প্রথমবয়সে ভারতমাতা, ভারতলক্ষ্মী প্রভৃতি শব্দগুলি বৃহদায়তন লাভ করিয়া আমাদের কল্পনাকে আচ্ছন্ন করিয়াছিল। কিন্তু মাতা যে কোথায় প্রত্যক্ষ আছেন তাহা কখনো স্পষ্ট করিয়া ভাবি নাই ; লক্ষ্মী দূরে থাকুন, তাহার পেচকটাকে পর্যন্ত কখনো চক্ষে দেখি নাই। আমরা বায়রনের কাব্য পড়িয়ছিলাম, গারিবলডির জীবনী আলোচনা করিয়াছিলাম এবং পেট্রিয়টিজমের ভােবর সসম্ভোগের নেশায় একেবারে তলাইয়া গিয়াছিলাম । মাতালের পক্ষে মদ্য যেরূপ খাদ্যের অপেক্ষা প্রিয় হয় আমাদের পক্ষেও দেশহিতৈষার নেশা স্বয়ং দেশের চেয়েও বড়ো হইয়া উঠিয়াছিল। যে দেশ প্রত্যক্ষ তাহার ভাষাকে বিস্মৃত হইয়া, তাহার ইতিহাসকে অপমান করিয়া, তাহার সুখদুঃখকে নিজের জীবনযাত্রা হইতে বহুদূরে রাখিয়াও, আমরা দেশহিতৈষী হইতেছিলাম। দেশের সহিত লেশমাত্র লিপ্ত না হইয়াও বিদেশীর রাজদরবারকেই