পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মশক্তি US চড়া দরে বিক্রয় হয়। আমাদের দেশে দরিদ্রের মধ্যে মনুষ্যত্ব ছিল, কারণ, আমাদের সমাজে সুখ স্বাস্থ্যু শিক্ষা আমোদ মোটের উপরে সকলে ভাগাভাগি করিয়া লইয়াছেন। ধনীর চণ্ডীমণ্ডপে যে পাঠশালা বসিয়াছে গরিবের ছেলেরা বিনা বেতনে তাহাতে শিক্ষা পাইয়াছে; রাজার সভায় যে উৎসব হইয়াছে দরিদ্র প্রজা বিনা আহবানে তাঁহাতে প্ৰবেশলাভ করিয়াছে । ধনীর বাগানে দরিদ্র প্রত্যহ পূজার ফুল তুলিয়াছে, কেহ তাহাকে পুলিসে দেয় নাই; সম্পন্ন ব্যক্তি দিঘি-ঝিল কাটাইয়া তাহার চারি দিকে পাহারা বসাইয়া রাখে নাই। ইহাতে দরিদ্রের আত্মসম্রাম ছিল, ধনীর ঐশ্বর্যে তাহার স্বাভাবিক দাবি ছিল, এইজন্য তাহার অবস্থা যেমনই হউক সে পাশবতা প্রাপ্ত হয় নাই—যাহারা জাতিভেদ ও মনুষ্যত্বের উচ্চ অধিকার লইয়া মুখস্থ বুলি আওড়ান। তাহারা এ-সব কথা ভালো করিয়া চিন্তা করিয়া দেখেন না। সুভূত লােভ করিবার দরকার কী? আমাদের কানে এ কথাটা অত্যন্ত বিদেশী, অত্যন্ত নিষ্ঠুর বলিয়া কিন্তু সমস্ত সহিতে হইবে। তাই বলিয়া বসিয়া বসিয়া আক্ষেপ করিলে চলিবে না। উপরে ইহার নির্ভর ছিল না- সমাজ ইহাকে রক্ষা করিয়াছে এবং সমাজকে ইহা রক্ষা করিয়াছে। এখন বিদ্যাশিক্ষা রাজার কাজ পাইবার সহায়স্বরূপ হইয়াছে, তখন বিদ্যাশিক্ষা সমাজের হিতসাধনের উপযোগী ছিল। এখন সমাজের সহিত বিদ্যার পরস্পর সহায়তার যোগ নাই। ইহাতে এতকাল পরে শিক্ষা সাধনব্যাপার ভারতবর্ষে রাজার প্রসাদী-অপেক্ষী হইয়াছে। করিতে হইবে, ভারতবষীয় ছাত্রের সর্বপ্রকার আত্মগৌরবকে সংকুচিত করিতে হইবে, তবে তাহাদিগকে দোষ দেওয়া যায় না- কর্তার ইচ্ছা কর্ম- আমরা সে কর্মের ফলভোগ করিব, কিন্তু সে কর্মের উপরে কর্তৃত্ব করিবার আশা করিব কিসের জোরে। তা ছাড়া, বিদ্যা জিনিসটা কলকারখানার সামগ্ৰী নহে। তাহা মনের ভিতর হইতে না দিলে দিবার কথা ভুলিয়াছেন যে সেখানে ছাত্র ও অধ্যাপকের মধ্যে ব্যবধান নাই, সুতরাং সেখানে বিদ্যার আদানপ্ৰদান স্বাভাবিক। শিক্ষক সেখানে বিদ্যাদানের জন্য উন্মুখ এবং ছাত্রেরাও বিদ্যালাভের জন্য প্ৰস্তুত— পরস্পরের মাঝখানে অপরিচয়ের দূরত্ব নাই, অশ্রদ্ধার কণ্টকপ্রাচীর নাই, কাজেই সেখানে মনের জিনিস মনে গিয়া পৌঁছায়। পেড়লারের মতো লোক আমাদের দেশের অধ্যাপক, শিক্ষাবিভাগের অধ্যক্ষ— তিনি আমাদিগকে কী দিতে পারেন, আমরাই বা তাহার কাছ হইতে কী লাইতে পারি। হৃদয়ে হৃদয়ে যেখানে স্পর্শ নাই, যেখানে সুস্পষ্ট বিরোধ ও বিদ্বেষ আছে, সেখানে দৈববিড়ম্বনায় যদি দানপ্রতিদানের সম্বন্ধ স্থাপিত হয় তবে সে-সম্বন্ধ হইতে শুধু নিশ্বফলতা নহে, কুফলতা প্ৰত্যাশা করা যায়। গ্রহণ করা। তাহাতে আমাদের বিদ্যামন্দিরে কেমব্রিজ-অকসফোর্ডের প্রকাণ্ড পাষাণ প্রতিরূপ প্রতিষ্ঠিত হইবে না জানি, তাহার সাজসরঞ্জাম দরিদ্রের উপযুক্ত হইবে, ধনীর চক্ষে তাহার অসম্পূর্ণতাও অনেক লক্ষিত হইবে।— কিন্তু জাগ্রত সরস্বতী শ্রদ্ধাশতদলে আসীন হইবেন, তিনি বাতায়নে দাড়াইয়া দূর হইতে ভিক্ষুকবিদায় করিবেন না। পরের কাছ হইতে হৃদ্যতাবিহীন দান লইবার একটা মস্ত লাঞ্ছনা। এই যে, গর্বিত দাতা খুব বড়ো করিয়া খরচের হিসাব রাখে, তাহার পরে দুই বেলা খোটা দেয়, “এত দিলাম, তত দিলাম, কিন্তু ফলে