পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মশক্তি لا 6 ما দেখিয়া ধৈর্যভ্ৰষ্ট না হইয়া আশার সহিত আনন্দের সহিত হৃদয়ের সমস্ত শ্ৰীতি দিয়া জীবনের সমস্ত শক্তি দিয়া তাহাকে সতেজ ও সফল করা। উপস্থিত ক্ষেত্রে ইহাই আমাদের একমাত্র আলোচ্য, একমাত্র কর্তব্য। ইহাকে যদি দুরাশা বলো, তবে কি পরের রুদ্ধদ্বারে জোড়হস্তে বসিয়া থাকাই আশা পূৰ্ণ হইবার একমাত্র সহজ প্রণালী ? কবে কন্সার্ভেটিব গবর্মেন্ট গিয়া লিবারেল গবর্মেন্টের অভ্যুদয় হইবে, ইহারই অপেক্ষা করিয়া শুষ্ক চঞ্চ বিস্তারপূর্বক নিদাঘমধ্যাহ্নের আকাশে তাকাইয়া থাকাই কি হতবুদ্ধি হতভাগ্যের একমাত্র সদুপায় ? আষাঢ় ১৩১১ অবস্থা ও ব্যবস্থা আজ বাংলাদেশে উত্তেজনার অভাব নাই, সুতরাং উত্তেজনার ভার কাহাকেও লাইতে হইবে না । উপদেশেরও যে বিশেষ প্রয়োজন আছে তাহা আমি মনে করি না। বসন্তকালের ঝড়ে যখন রাশি রাশি আমের বোল ঝরিয়া পড়ে তখন সে বোলগুলি কেবলই মাটি হয়, তাহা হইতে গাছ বাহির হইবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। তেমনি দেখা গেছে, সংসারে উপদেশের বোল অজস্র বৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু অনেক স্থলেই তাহা হইতে অন্ধুর বাহির হয় না, সমস্ত মাটি হইতে থাকে। তবু ইহা নিঃসন্দেহ যে, যখন বোল ঝরিতে আরম্ভ করে তখন বুঝিতে হইবে ফল ফলিবার সময় সুদূরে নাই। আমাদের দেশেও কিছুদিন হইতে বলা হইতেছিল যে, নিজের দেশের অভাবমোচন নহে, ইত্যাদি। নানা মুখ হইতে এই-যে বোলগুলি ঝরিতে আরম্ভ হইয়াছিল তাহা উপস্থিতমত মাটি হইতেছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু ভূমিকে নিশ্চয়ই উর্বরা করিতেছিল এবং একটা সফলতার সময় যে আসিতেছে তাহারও সূচনা করিয়াছিল। অবশেষে আজ বিধাতা তীব্ৰ উত্তাপে একটি উপদেশ স্বয়ং পাকাইয়া তুলিয়াছেন। দেশ। গতকল্য যে-সকল কথা কৰ্ণপাত করিবার যোগ্য বলিয়া বিবেচনা করে নাই আজ তাহা অতি অনায়াসেই চিরন্তন সত্যের ন্যায় গ্ৰহণ করিতেছে। নিজেরা যে এক হইতে হইবে, পরের দ্বারস্থ হইবার জন্য নহে, নিজেদের কাজ করিবার জন্য, এ কথা আজ আমরা একদিনেই অতি সহজেই যেন অনুভব করিতেছি- বিধাতার বাণীকে অগ্রাহ্য করিবার জো নাই। অতএব, আমার মুখে আজ উত্তেজনা ও উপদেশ অনাবশ্যক হইয়াছে— ইতিহাসকে যিনি, অমোঘ। ইঙ্গিতের দ্বারা চালনা করেন তাহার অগ্নিময় তর্জনী আজ দেশের সকলের চক্ষের সম্মুখে প্ৰত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে। এখন এই সময়টাকে বৃথা নষ্ট হইতে দিতে পারি না। কপালক্রমে অনেক ধোঁওয়ার পরে ভিজা কাঠ যদি ধরিয়া থাকে, তবে তাহা পুড়িয়া ছাই হওয়ার পূর্বে রান্না চড়াইতে হইবে ; শুধু শুধু শূন্য চুলায় আগুনে খোচার উপর খোচা দিতে থাকিলে আমোদ হইতে পারে, কিন্তু তাহাতে ছাই হওয়ার কালটাও নিকটে অগ্রসর হয় এবং অন্নের আশা সুদূরবতী হইতে থাকে। বঙ্গব্যবচ্ছেদের প্রস্তাবে যখন সমস্ত দেশের লোকের ভাবনাকে একসঙ্গে জাগাইয়া তুলিয়াছে তখন কেবলমাত্র সাময়িক উত্তেজনায় আত্মবিস্মৃত না হইয়া কতকগুলি গোড়াকার কথা স্পষ্টরূপে ভাবিয়া লইতে হইবে। প্ৰথম কথা এই যে, আমরা স্বদেশের হিতসাধন সম্বন্ধে নিজের কাছে যে-সকল আশা করি না। পরের কাছ হইতে সে-সকল আশা করিতেছিলাম। এমন অবস্থায় নিরাশ হওয়াই স্বাভাবিক এবং তাহাই মঙ্গলকর। নিরাশ হইবার মতো আঘাত বারবার পাইয়াছি, কিন্তু চেতনা হয় নাই। এবারে ঈশ্বরের প্রসাদে আর-একটা আঘাত পাইয়াছি, চেতনা হইয়াছে কি না তাহার প্রমাণ পরে পাওয়া যাইবে ।