পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

O রবীন্দ্র-রচনাবলী سbr\ লইয়া আমরাও কি আমাদের দেশের কৃষির উন্নতিতে প্ৰবৃত্ত হইতে পারিতাম না ? আমাদের ডাক্তার আমরা গ্ৰহণ করিতে পারি না ? যাহাতে মামলা-মকদ্দমায় লোকের চরিত্র ও সম্বল নষ্ট না হইয়া সহজ বিচারপ্রণালীতে সালিস-নিম্পত্তি দেশে চলে তাহার ব্যবস্থা করা কি আমাদের সাধ্যাতীত ? সমস্তই সম্ভব হয়, যদি আমাদের এই-সকল স্বদেশী চেষ্টাকে যথার্থভাবে প্রয়োগ করিবার জন্য একটা দল বাধিতে পারি। এই দল, এই কর্তৃসভা আমাদিগকে স্থাপন করিতেই হইবে।-- নতুবা বলিব, আজ আমরা যে-একটা উত্তেজনা প্রকাশ করিতেছি তাহা মাদকতা মাত্র, তাহার অবসানে অবসাদের পঙ্কশয্যায় লুণ্ঠন করিতে হইবে। একটা কথা আমাদিগকে ভালো করিয়া বুঝিতে হইবে যে, পরের প্রদত্ত অধিকার আমাদের জাতীয় সম্পদরাপে গণ্য হইতে পারে না— বরঞ্চ তাহার বিপরীত। দৃষ্টান্তস্বরূপে একবার পঞ্চায়েতবিধির কথা ভাবিয়া দেখুন। একসময়ে পঞ্চায়েত আমাদের দেশের জিনিস ছিল, এখন পঞ্চায়েত গবৰ্মেন্টের আফিসে-গড়া জিনিস হইতে চলিল। যদি ফলবিচার করা যায়। তবে এই দুই পঞ্চায়েতের প্রকৃতি একেবারে পরস্পরের বিপরীত বলিয়াই প্ৰতীত হইবে। যে পঞ্চায়েতের ক্ষমতা গ্রামের লোকের স্বতঃপ্রদত্ত নহে, যাহা গবৰ্মেন্টের দত্ত, তাহা বাহিরের জিনিস হওয়াতেই গ্রামের বক্ষে একটা অশান্তির মতো চাপিয়া বসিবে— তাহা ঈর্ষার সৃষ্টি করিবে- এই পঞ্চায়েত পদ লাভ করিবার জন্য অযোগ্য লোকে এমন-সকল চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইবে যাহাতে বিরোধ জন্মিতে থাকিবে—পঞ্চায়েত ম্যাজিস্ট্রেটবগকেই স্বপক্ষ এবং গ্রামকে অপর পক্ষ বলিয়া জানিবে এবং ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট বাহবা পাইবার জন্য গোপনে অথবা প্ৰকাশ্যে গ্রামের বিশ্বাসভঙ্গ করিবে— ইহারা গ্রামের লোক হইয়া গ্রামের চরের কাজ করিতে বাধ্য হইবে এবং যে পঞ্চায়েত এ দেশে গ্রামের বলস্বরূপ ছিল সেই পঞ্চায়েতই গ্রামের দুর্বলতার কারণ হইবে। ভারতবর্ষের যে-সকল গ্রামে এখনো গ্ৰাম্য পঞ্চায়েতের প্রভাব বর্তমান আছে, যে পঞ্চায়েত কালক্রমে শিক্ষার বিস্তার ও অবস্থার পবিবর্তন-অনুসারে স্বভাবতই স্বাদেশিক পঞ্চায়েতে পরিণত হইতে পারিত, যে-গ্রামপঞ্চায়েতগণ একদিন স্বদেশের সাধারণ কার্যে পরস্পরের মধ্যে যোগ বাধিয়া দাড়াইবে এমন আশা করা যাইত- সেই-সকল গ্রামের পঞ্চায়েতগণের মধ্যে একবার যদি গবমেন্টের বেনো জল প্ৰবেশ করে, তবে পঞ্চায়েতের পঞ্চায়েতত্ব চিরদিনের মতো ঘুচিল। দেশের জিনিস হইয়া তাহারা যে কাজ করিত গবর্মেন্টের জিনিস হইয়া তাহার সম্পূর্ণ উলটারকম কাজ করিবে । ইহা হইতে আমাদিগকে বুঝিতে হইবে, দেশের হাত হইতে আমরা যে ক্ষমতা পাই তাহার প্রকৃতি একরকম, আর পরের হাত হইতে যাহা পাই তাহার প্রকৃতি সম্পূর্ণ অন্যরকম হইবেই। কারণ, মূল্য না দিয়া কোনো জিনিস আমরা পাইতেই পারি না। সুতরাং দেশের কােছ হইতে আমরা যাহা পাইব সেজন্য দেশের কাছেই আপনাকে বিকাইতে হইবে— পরের কাছ হইতে যাহা পাইব সেজন্য পরের কাছে না বিকাইয়া উপায় নাই। এইরূপ বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ যদি পরের কাছে মাগিয়া লইতে হয় তবে পরের গোলামি করিতেই হইবে- যাহা স্বাভাবিক, তাহার জন্য আমরা বৃথা চীৎকার করিয়া র কেন ? দৃষ্টান্তস্বরূপ আর-একটা কথা বলি। মহাজনেরা চাষিদের অধিক সুদে কর্জ দিয়া তাহাদের সর্বনাশ করিতেছে, আমরা প্রার্থনা ছাড়া অন্য উপায় জানি না— অতএব গবমেন্টকেই অথবা বিদেশী মহাজনাদিগকে যদি আমরা বলি যে, তোমরা অল্প সুদে আমাদের গ্রামে গ্রামে কৃষি-ব্যাঙ্ক স্থাপন করো, দেওয়া হয় না ? যাহারা যথার্থই দেশের বল, দেশের সম্পদ, তাহদের প্রত্যেকটিকে কি পরের হাতে এমনি করিয়া বাধা রাখিতে হইবে ? আমরা যে পরিমাণেই দেশের কাজ পরকে দিয়া করাইব সেই পরিমাণেই আমরা নিজের শক্তিকেই বিকাইতে থাকিব, দেশকে স্বেচ্ছাকৃত অধীনতাপাশে উত্তরোত্তর অধিকতর বঁাধিতে থাকিব- এ কথা কি বুঝা এতই কঠিন ? পরের প্রদত্ত ক্ষমতা আমাদের পক্ষে