পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vb J রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী একটি বিশ্ববঙ্গপ্রতিনিধিসভা প্ৰতিষ্ঠিত হইতে পরিবে । আমরা এই সময়ে এই উপলক্ষে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎকে বাংলার ঐক্যসাধনযজ্ঞে বিশেষভাবে সাধ্যমত স্বদেশের পরিচয়লাভ ও তাহার জ্ঞানভাণ্ডারপূরণ করিতেছেন। এই পরিষৎকে জেলায় জেলায় আপনার শাখাসভা স্থাপন করিতে হইবে, এবং পর্যায়ক্রমে এক-একটি জেলায় গিয়া পরিষদের ঐক্য সম্বন্ধে সমস্ত দেশকে সচেতন করিবার, এই ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে আপনি স্বাধীন কর্তব্য পালন করিবার ভার সাহিত্য-পরিষৎ গ্রহণ করিয়াছেন। এখন সময় উপস্থিত হইয়াছে— এখন সমস্ত দেশকে যখন দেখা যাইতেছে বাহির হইতে আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিবার চেষ্টা নিয়ত সতর্ক রহিয়াছে তখন তাহার প্রতিকারের জন্য নানারূপে কেবলই দল বাধিবার দিকে আমাদের সমস্ত চেষ্টাকে নিযুক্ত করিতে হইবে । যে গুণে মানুষকে একত্র করে তাহার মধ্যে একটা প্ৰধান গুণ বাধ্যতা। কেবলই অন্যকে খাটো করিবার চেষ্টা, তাহার ক্রটি ধরা, নিজেকে কাহারও চেয়ে নূ্যন মনে না করা, নিজের একটা মত অনাদৃত হইলেই অথবা নিজের একটুখানি সুবিধার ব্যাঘাত হইলেই দল ছাড়িয়া আসিয়া তাহার বিরুদ্ধাচরণ করিবার প্রয়াস— এইগুলিই সেই শয়তানের প্রদত্ত বিষ যাহা মানুষকে বিশ্লিষ্ট করিয়া দেয়, যজ্ঞ নষ্ট করে। ঐক্যরক্ষার জন্য আমাদিগকে অযোগ্যের কর্তৃত্বও স্বীকার করিতে হইবে— ইহাতে মহান সংকল্পের নিকট নত হওয়া হয়, অযোগ্যতার নিকট নহে। বাঙালিকে ক্ষুদ্র আত্মাভিমান দমন করিয়া নানারূপে বাধ্যতার চর্চা করিতে হইবে, নিজে প্রধান হইবার চেষ্টা মন হইতে সম্পূর্ণরূপে দূর করিয়া অন্যকে প্ৰধান করিবার চেষ্টা করিতে হইবে । সর্বদাই অন্যকে সন্দেহ করিয়া, অবিশ্বাস করিয়া, উপহাস করিয়া, তীক্ষ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় না দিয়া, বরঞ্চ নম্রভাবে বিনা বাক্যব্যয়ে ঠকিবার জন্যও প্ৰস্তুত হইতে হইবে। সম্প্রতি এই কঠিন সাধনা আমাদের সম্মুখে রহিয়াছে— আপনাকে খর্ব করিয়া আপনাদিগকে বড়ো করিবার এই সাধনা, খর্বকে বিসর্জন দিয়া গৌরবকে আশ্রয় করিবার এই সাধনা— ইহা যখন আমাদের সিদ্ধ হইবে তখন আমরা সর্বপ্রকার কর্তৃত্বের যথার্থ যোগ্য হইব। ইহাও নিশ্চিত, যথার্থ যোগ্যতাকে পৃথিবীতে কোনো শক্তিই প্রতিরোধ করিতে পারে না। আমরা যখন কর্তৃত্বের ক্ষমতা লাভ করিব তখন আমরা দাসত্ব করিব না— তা আমাদের প্রভু যত বড়োই প্রবল হউন । জল যখন জমিয়া কঠিন হয় তখন সে লোহার পাইপকেও ফাটাইয়া ফেলে। আজ আমরা জলের মতো তরল আছি, যন্ত্রীর ইচ্ছামত যন্ত্রের তাড়নায় লোহার কলের মধ্যে শত শত শাখাপ্ৰশাখায় ধাবিত হইতেছি— জমাট বাধিবার শক্তি জন্মিলেই লোহার বাধনকে হার মানিতেই হইবে । আমাদের নিজের দিকে যদি সম্পূৰ্ণ ফিরিয়া দাড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশমাত্র কারণ দেখি না। বাহিরের কিছুতে আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিবে, এ কথা আমরা কোনোমতেই স্বীকার করিব না। কৃত্ৰিম বিচ্ছেদ যখন মাঝখানে আসিয়া দাড়াইবে তখনই আমরা সচেতনভাবে অনুভব করিব যে, বাংলার পূর্ব-পশ্চিমকে চিরকাল একই জাহ্নবী তাহার বহু বাহুপাশে বাধিয়াছেন ; একই ব্ৰহ্মপুত্র তাহার প্রসারিত আলিঙ্গনে গ্রহণ করিয়াছেন ; এই পূর্ব-পশ্চিম, হৃৎপিণ্ডের দক্ষিণ-বাম অংশের ন্যায়, একই পুরাতন রক্তস্রোতে সমস্ত বঙ্গদেশের শিরা-উপশিরায় প্রাণবিধান করিয়া আসিয়াছে; এই পূর্ব-পশ্চিম, জননীর বাম-দক্ষিণ স্তনের ন্যায়, চিরদিন বাঙালির সস্তানকে পালন করিয়াছে। আমাদের কিছুতেই পৃথক করিতে পারে এ ভয় যদি আমাদের জন্মে। তবে সে ভয়ের কারণ নিশ্চয়ই আমাদেরই মধ্যে আছে এবং তাহার প্রতিকার আমাদের নিজের চেষ্টা ছাড়া আর-কোনো কৃত্রিম উপায়ের দ্বারা হইতে পারে না। কর্তৃপক্ষ আমাদের একটা-কিছু করিলেন বা না করিলেন বলিয়াই যদি আমাদের সকল দিকে সর্বনাশ হইয়া গেল বলিয়া আশঙ্কা করি, তবে কোনো কৌশললব্ধ সুযোগে কোনো প্রার্থনালব্ধ অনুগ্রহে আমাদিগকে অধিক দিন রক্ষা করিতে পরিবে না। ঈশ্বর আমাদের নিজের হাতে যাহা দিয়াছেন তাহার