পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভারতবর্ষ। °C公 সকল দেশেই একজন অচেনা বিদেশী পথিক অপূর্ব বেশভূষায় আসিয়া উপস্থিত হইলে, স্থানীয় সন্দেহ করিয়া বিব্রত করিয়া তোলে। ভারতবাসী অতি সহজে তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করে— তাহার দ্বারা আহত হয় না, এবং তাঁহাকে আঘাত করে না। চৈনিক পরিব্রাজক ফাহিয়ান, হিয়োনথসাং, যেমন অনায়াসে আত্মীয়ের ন্যায়। ভারত পরিভ্রমণ করিয়া গিয়াছিলেন, যুরোপে কখনো সেরূপ পারিতেন না। ধর্মের ঐক্য বাহিরে পরিদৃশ্যমান নহে— যেখানে ভাষা, আকৃতি, বেশভুষা, সমস্তই স্বতন্ত্র সেখানে কৌতুহলের নিষ্ঠুর আক্রমণকে পদে পদে অতিক্রম করিয়া চলা অসাধ্য। কিন্তু ভারতবষীয় একাকী আত্মসমাহিত, সে নিজের চারি দিকে একটি চিরস্থায়ী নির্জনতা বহন করিয়া চলে— সেইজন্য কেহ। তাহার একেবারে গায়ের উপর আসিয়া পড়ে না। অপরিচিত বিদেশী তাহার পাশ্ব দিয়া চলিয়া যাইবার যথেষ্ট স্থান পায়। যাহারা সর্বদাই ভিড় করিয়া, দল বাধিয়া, রাস্তা জুড়িয়া বসিয়া থাকে তাহাদিগকে আঘাত না করিয়া এবং তাঁহাদের কাছ হইতে আঘাত না পাইয়া নূতন লোকের চলিবার সম্ভাবনা নাই। তাহাকে সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়া, সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া, তবে এক পা অগ্রসর হইতে হয়। কিন্তু ভারতবর্ষীয় যেখানে থাকে, সেখানে কোনো বাধা রচনা করে না- তাহার স্থানের টানাটানি নাই, তাহার একাকিত্বের অবকাশ কেহ কাডিয়া লইতে পারে না। গ্রীক হউক, আরব হউক, চৈন হউক, সে জঙ্গলের ন্যায় কাহাকেও আটক করে না ; বনস্পতির ন্যায় নিজের তলদেশে চারি দিকে অবাধ স্থান রাখিয়া দেয় ; আশ্রয় লইলে ছায়া দেয়, চলিয়া গেলে কোনো কথা বলে না। এই একাকিত্বের মহত্ত্ব যাহার চিত্ত আকর্ষণ করে না সে ভারতবর্ষকে ঠিকমত চিনিতে পরিবে না। বহুশতাব্দী ধরিয়া প্ৰবল বিদেশী উন্মত্ত বরাহের ন্যায়। ভারতবর্ষকে এক প্ৰান্ত হইতে আর-এক প্ৰান্ত পর্যন্ত দস্তদ্বারা বিদীর্ণ করিয়া ফিরিয়াছিল, তখনো ভারতবর্ষ আপন বিস্তীর্ণ একাকিত্বদ্বারা পরিরক্ষিত ছিল— কেহই তাহার মর্মস্থানে আঘাত করিতে পারে নাই। ভারতবর্ষ যুদ্ধবিরোধ না করিয়াও নিজেকে নিজের মধ্যে অতি সহজে স্বতন্ত্র করিয়া রাখিতে জানে— সেজন্য এপর্যন্ত অস্ত্ৰধারী প্রহরীর প্রয়োজন হয় নাই। কৰ্ণ যেরূপ সহজ কবচ লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, ভারতবর্ষীয় প্রকৃতি সেইরূপ একটি সহজ বেষ্টনের দ্বারা আবৃত, সর্বপ্রকার বিরোধ-বিপ্লবের মধ্যেও একটি দুৰ্ভেদ্য শান্তি তাহার সঙ্গে সঙ্গে অচলা হইয়া ফিরে, তাই সে ভাঙিয়া পড়ে না, মিশিয়া যায় না, কেহ তাহাকে গ্ৰাস করিতে পারে না, সে উন্মত্ত ভিড়ের মধ্যেও একাকী বিরাজ করে। যুরোপ ভোগে একাকী, কমে দলবদ্ধ। ভারতবর্ষ তাহার বিপরীত। ভারতবর্ষ ভাগ করিয়া ভোগ করে, কর্ম করে একাকী। যুরোপের ধনসম্পদ আরাম সুখ নিজের ; কিন্তু তাহার দানধ্যান, স্কুলকলেজ, ধর্মচৰ্চা, বাণিজ্যব্যবসায়, সমস্ত দল বাধিয়া। আমাদের সুখসম্পত্তি একলার নাহে ; আমাদের দানধ্যান অধ্যাপন— আমাদের কর্তব্য একলার । এই ভাবটাকে চেষ্টা করিয়া নষ্ট করিতে হইবে, এমন প্ৰতিজ্ঞা করা কিছু নহে; করিয়াও বিশেষ ফল হয় নাই, হইবেও না। এমন-কি, বাণিজ্যব্যবসায়ে প্রকাণ্ড মূলধন এক জায়গায় মস্ত করিয়া উঠাইয়া তাহার আওতায় ছোটাে ছোটাে সামর্থ্যগুলিকে বলপূর্বক নিস্ফল করিয়া তোলা শ্রেয়স্কর বোধ করি না। ভারতবর্ষের তন্তুবায় যে মরিয়াছে সে একত্ৰ হইবার ক্রটিতে নহে ; তাহার যন্ত্রের উন্নতির অভাবে । তাত যদি ভালো হয় এবং প্রত্যেক তন্তুবায় যদি কাজ করে, অন্ন করিয়া খায়, সন্তুষ্টচিত্তে জীবনযাত্ৰা নির্বাহ করে, তবে সমাজের মধ্যে প্রকৃত দারিদ্র্যের ও ঈর্ষার বিষ জমিতে পায় না এবং ম্যাঞ্চেস্টর তাহার জটিল কলকারখানা লইয়াও ইহাদিগকে বধ করিতে পারে না। একটি শিক্ষিত জাপানি বলেন, “তোমরা বহুব্যয়সাধ্য বিদেশী কল লইয়া বড়ো কারবার ফাদিতে চেষ্টা করিয়ো না । আমরা জার্মানি হইতে একটা বিশেষ কল আনাইয়া অবশেষে কিছুদিনেই সস্তা কাঠে তাহার সুলভ ও সরল প্ৰতিকৃতি করিয়া শিল্পীসম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে তাহা প্রচারিত করিয়া দিয়াছি; ইহাতে কাজের উন্নতি হইয়াছে, সকলে আহারও পাইতেছে।” এইরূপে যন্ত্রতন্ত্রকে অত্যন্ত সরল ও সহজ করিয়া