পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভারতবর্ষسمجھے ー つ 。 থাকি, যদি এ শিক্ষা আমরা কোনো কাজে খাটাইতে পারি, তাহা আমাদের গুণ। আমাদের নিজের হাতে লইতে হইবে এবং যাহাতে শিশুকাল হইতে ছেলেরা স্বদেশীয় ভাবে, স্বদেশী প্ৰণালীতে, স্বদেশের সহিত হৃদয়মনের যোগ রক্ষা করিয়া স্বদেশের বায়ু ও আলোক প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত রাখিয়া শিক্ষা পাইতে পারে, তাহার জন্য আমাদিগকে একান্ত প্রযত্নে চেষ্টা করিতে হইবে। ভারতবর্ষ সুদীর্ঘকাল ধরিয়া আমাদের মনের যে প্রকৃতিকে গঠন করিয়াছে তাহাকে নিজের বা পরের ইচ্ছামত বিকৃত করিলে আমরা জগতে নিস্ফল ও লজ্জিত হইব। সেই প্রকৃতিকেই পূৰ্ণ পরিণতি দিলে সে অনায়াসেই বিদেশের জিনিসকে আপনার করিয়া লইতে পরিবে এবং আপনার জিনিস বিদেশকে দান করিতে পরিবে । এই স্বদেশী প্ৰণালীর শিক্ষার প্রধান ভিত্তি স্বাৰ্থত্যাগপর ভূতিনিরপেক্ষ অধ্যয়ন-অধ্যাপনরত নিষ্ঠাবান গুরু এবং তাহার অধ্যাপনের প্রধান অবলম্বন স্বদেশের একখানি সম্পূর্ণ ইতিহাস। একদিন এইরূপ গুরু আমাদের দেশে গ্রামে গ্রামেই ছিলেন- ‘তাঁহাদের জুতামোজা গাড়িঘোড়া আসবাবপত্রের প্রয়োজনই ছিল না— নবাব ও নবাবের অনুকারিগণ তাহদের চারি দিকে নবাবি করিয়া বেড়াইত, তাহাতে তাহদের দৃকপাত ছিল না, তাহাদের আগৌরব ছিল না। এখনো আমাদের দেশে সেই-সকল গুরুর অভাব নাই। কিন্তু শিক্ষার বিষয় পরিবর্তিত হইয়াছে- এখন ব্যাকরণ স্মৃতি ও ন্যায় আমাদের জঠরানালনির্বাণের সহায়তা করে না এবং আধুনিক কালের জ্ঞানস্পাহা মিটাইতে পারে না। কিন্তু যাহারা পণ্যদ্রব্য করিয়া বিদ্যাকেও হীন করিয়াছেন নিজেকেও হীন করিয়াছেন। নব্যশিক্ষিতদের মধ্যে আমাদের সামাজিক উচ্চ আদর্শের এই বিপর্যয়ন্দশা একদিন সংশোধিত হইবে, ইহা আমি দুরাশা বলিয়া গণ্য করি না। আমাদের বৃহৎ শিক্ষিতমণ্ডলীর মধ্যে ক্রমে ক্রমে এমন দুই-চারিটি লোক নিশ্চয়ই উঠিবেন যাহারা বিদ্যাব্যবসায়কে ঘূণা করিয়া বিদ্যাদানকে কৌলিক ব্ৰত বলিয়া গ্ৰহণ করিবেন। তাহারা জীবনযাত্রার উপকরণ সংক্ষিপ্ত করিয়া, বিলাস বিসর্জন দিয়া, দেশের স্থানে স্থানে যে আধুনিক শিক্ষার টােল করিবেন, ইনসাপেক্টরের গর্জন ও য়ুনিভারসিটির তর্জন – বর্জিত সেই-সকল টােলেই বিদ্যা স্বাধীনতা লাভ করিবে, মর্যাদা লাভ করিবে। ইংরাজ রাজ-বণিকের দৃষ্টান্ত ও শিক্ষা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এমনতরো জনকয়েক গুরুকে জন্ম দিতে পরিবে, এ বিশ্বাস আমার মনে দৃঢ় রহিয়াছে । ব্ৰাহ্মণ সকলেই জানেন, সম্প্রতি কোনো মহারাষ্ট্র ব্রাহ্মণকে তাহার ইংরাজ প্ৰভু পাদুকাঘাত করিয়াছিল ; তাহার বিচার উচ্চতম বিচারালয় পর্যন্ত গড়াইয়াছিল— শেষ, বিচারক ব্যাপারটাকে তুচ্ছ বলিয়া ঘটনাটা এতই লাজজকের যে, মাসিক পত্রে আমরা ইহার অবতারণা করিতাম না | মারা খাইয়া মারা উচিত বা ক্ৰন্দন করা উচিত বা নালিশ করা উচিত, সে-সমস্ত আলোচনা খবরের কাগজে হইয়া গেছে- সে-সকল কথাও আমরা তুলিতে চাহি না। কিন্তু এই ঘটনাটি উপলক্ষ করিয়া যে-সকল বিচারক এই ঘটনাটিকে তুচ্ছ বলেন- কাজেও দেখিতেছি। ইহা তুচ্ছ হইয়া উঠিয়াছে, সুতরাং তিনি অন্যায় বলেন নাই। কিন্তু এই ঘটনাটি তুচ্ছ বলিয়া গণ্য হওয়াতেই বুঝিতেছি, আমাদের সমাজের বিকার দ্রুতবেগে অগ্রসর হইতেছে।