পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Տ Հ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী নেশার মধ্যে স্থিতির আদর্শ, লক্ষ্যের আদর্শ, পরিণতির আদর্শ ধরিয়া থাকেন। কিন্তু দুই দণ্ড দাড়াইয়া শুনিবে কে ? সম্মিলিত প্ৰকাণ্ড স্বার্থের প্রচণ্ড বেগকে এই প্রকারের দুই-একজন লোক তর্জনী উঠাইয়া রুখিবেন কী করিয়া ! বাণিজ্য—জাহাজে উনপঞ্চাশ পালে হাওয়া লাগিয়াছে, য়ুরোপের প্রান্তরে উন্মত্ত দর্শকবৃন্দের মাঝখানে সারি সারি যুদ্ধ-ঘোড়ার ঘোড়দৌড় চলিতেছে— এখন ক্ষণকালের জন্য থামিবে কে ? এই উন্মত্ততায়, এই প্ৰাণপণে নিজ শক্তির একান্ত উদঘািট্টনে, আধ্যাত্মিকতার জন্ম হইতে পারে এমন তর্ক আমাদের মনেও ওঠে। এই বেগের আকর্ষণ অত্যন্ত বেশি ; ইহা আমাদিগকে প্রলুব্ধ করে ; ইহা যে প্রলয়ের দিকে যাইতে পারে, এমন সন্দেহ আমাদের হয় না। ইহা কী প্রকারের ? যেমন চীরধারী যে-একটি দল নিজেকে সাধু ও সাধক বলিয়া পরিচয় দেয় তাহারা গাজার নেশাকে আধ্যাত্মিক আনন্দলাভের সাধনা বলিয়া মনে করে। নেশায় একাগ্ৰতা জন্মে, উত্তেজনা হয়, কিন্তু তাহাতে আধ্যাত্মিক স্বাধীন সবলতা হ্রাস হইতে থাকে। আর-সমস্ত ছাড়া যায়, কিন্তু এই নেশার উত্তেজনা ছাড়া যায় না- ক্ৰমে মনের বল যত কমিতে থাকে নেশার মাত্ৰাও তত বাড়াইতে হয়। ঘুরিয়া নৃত্য করিয়া বা সশব্দে বাদ্য বাজাইয়া, নিজেকে উদভ্ৰান্ত ও মূৰ্ছান্বিত করিয়া, যে ধর্মোন্মাদের বিলাস সম্ভোগ করা যায় তাহাও কৃত্রিম। তাহাতে অভ্যাস জন্মিয়া গেলে, তাহা শান্ত একনিষ্ঠ সাধনা ব্যতীত যথার্থ স্থায়ী মূল্যবান কোনো জিনিস পাওয়া যায় না ও স্থায়ী মূল্যবান কোনো জিনিস রক্ষা করা যায় না । অথচ আবেগ ব্যতীত কাজ ও কাজ ব্যতীত সমাজ চলিতে পারে না। এইজন্যই ভারতবর্ষ আপন সমাজে গতি ও স্থিতির সমন্বয় করিতে চাহিয়াছিল। ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য প্রভৃতি যাহারা হাতে কলমে সমাজের কার্যসাধন করে তাহদের কর্মের সীমা নির্দিষ্ট ছিল । এইজন্যই ক্ষত্ৰিয় ক্ষত্রধর্মের আদর্শ রক্ষা করিয়া নিজের কর্তব্যকে ধর্মের মধ্যে গণ্য করিতে পারিত । স্বার্থ ও প্রবৃত্তির উর্ধের্ব ধর্মের উপরে কর্তব্য স্থাপন করিলে, কাজের মধ্যেও বিশ্রাম এবং আধ্যাত্মিকতালাভের অবকাশ পাওয়া যায় । য়ুরোপীয় সমাজ যে নিয়মে চলে তাহাতে গতিজনিত বিশেষ একটা ঝোকের মুখেই অধিকাংশ লোককে ঠেলিয়া দেয়। সেখানে বুদ্ধিজীবী লোকেরা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারেই ঝুঁকিয়া পড়ে, সাধারণ লোকে অর্থে পার্জনেই ভিড় করে। বর্তমানকালে সাম্রাজ্যলোলুপতা সকলকে গ্ৰাস করিয়াছে এবং জগৎ জুড়িয়া লঙ্কাভাগ চলিতেছে। এমন সময় হওয়া বিচিত্র নহে যখন বিশুদ্ধজ্ঞানচর্চা যথেষ্ট লোককে আকর্ষণ করিবে না । এমন সময় আসিতে পারে যখন আবশ্যক হইলেও সৈন্য পাওয়া যাইবে না। কারণ, প্রবৃত্তিকে কে ঠেকাইবে ? যে জার্মািন একদিন পণ্ডিত ছিল সে জার্মানি যদি বণিক হইয়া দাড়ায়, তবে তাহার পাণ্ডিত উদ্ধার করিবে কে ? যে ইংরাজ একদিন ক্ষত্ৰিয়ভাবে আর্তন্ত্রাণব্ৰত গ্ৰহণ কবিয়ছিল সে যখন গায়ের জোরে পৃথিবীর চতুর্দিকে নিজের দোকানদারি চালাইতে ধাবিত হইয়াছে, তখন তাহাকে তাহার সেই পুরাতন উদার ক্ষত্ৰিয়ভাবে ফিরাইয়া আনিবে কোন শক্তিতে ? এই ঝোকের উপরেই সমস্ত কর্তৃত্ব না দিয়া সংযত সুশৃঙ্খল কর্তব্যবিধানের উপরে কর্তৃত্বভার দেওয়াই ভারতবর্ষীয় সমাজপ্ৰণালী। সমাজ যদি সজীব থাকে, বাহিরের আঘাতের দ্বারা অভিভূত হইয়া না পড়ে, তবে এই প্ৰণালী অনুসারে সকল সময়েই সমাজে সামঞ্জস্য থাকে—এক দিকে হঠাৎ হুড়ামুডি পড়িয়া অন্য দিক শূন্য হইয়া যায় না। সকলেই আপনি আদর্শ রক্ষা করে এবং আপনি কাজ করিয়া গৌরব বোধ করে । কিন্তু কাজের একটা বেগ আছেই। সেই বেগে সে আপনার পরিণাম ভুলিয়া যায়। কাজ তখন নিজেই লক্ষ্য হইয়া উঠে। শুদ্ধমাত্র কর্মের বেগের মুখে নিজেকে ছাড়িয়া দেওয়াতে সুখ আছে। কর্মের ভূত কমী লোককে পাইয়া বসে। শুদ্ধ তাঁহাই নহে। কাৰ্যসাধনই যখন অত্যন্ত প্ৰাধান্য লাভ করে তখন উপায়ের বিচার ক্রমেই