পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভারতবর্ষ। Գ Տ)Ç জড় অনুষ্ঠানে জ্ঞানকে সে আধ মরা করিয়া পিজরার মধ্যে আবদ্ধ করিয়াছে বলিয়া, আমরা যুরোপীয় আদর্শের সহিত নিজেদের আদর্শের তুলনা করিয়া গৌরব অনুভব করিবার অবকাশ পাই না। আমরা কথায় কথায় লজ্জা পাই। আমাদের সমাজের দুর্ভেদ্য জড়স্তৃপ হিন্দুসভ্যতার কীর্তিস্তম্ভ নহে; ইহার অনেকটাই সুদীর্ঘকালের যত্নসঞ্চিত ধূলামাত্র। অনেক সময় যুরোপীয় সভ্যতার কাছে ধিককার পাইয়া আমরা এই ধূলিস্তৃপকে লইয়াই গায়ের জোরে গর্ব করি, কালের এই সমস্ত অনাহুত আবর্জনারাশিকেই । আমরা আপনার বলিয়া অভিমান করি— ইহার অভ্যন্তরে যেখানে আমাদের যথার্থ গর্বের ধন হিন্দুসভ্যতার প্রাচীন আদর্শ আলোক ও বায়ুর অভাবে মূৰ্ছান্বিত হইয়া পড়িয়া আছে সেখানে দৃষ্টিপাত করিবার পথ পাই না । * প্রাচীন ভারতবর্ষ সুখ, স্বার্থ, এমন-কি, ঐশ্বৰ্যকে পর্যন্ত খর্ব করিয়া মঙ্গলকেই যে ভাবে সমাজের প্রতিষ্ঠাস্থল করিবার চেষ্টা করিয়াছিল এমন আর কোথাও হয় নাই। অন্য দেশে ধনমানের জন্য, প্ৰভুত্ব-অর্জনের জন্য, হানাহানি-কাড়াকড়ি করিতে সমাজ প্রত্যেককেই উৎসাহ দিয়া থাকে। ভারতবর্ষ সেই উৎসাহকে সর্বপ্রকারে নিরস্ত করিয়াছে; কারণ, স্বার্থোল্পতি তাহার লক্ষ্য ছিল না, মঙ্গলই তাহার লক্ষ্য ছিল। আমরা ইংরাজের ছাত্র আজ বলিতেছি, এই প্রতিযোগিতা এই হানাহানির অভাবে আমাদের আজ দুৰ্গতি হইয়াছে। প্রতিযোগিতার উত্তরোত্তর প্রশ্রয়ে ইংলন্ড ফ্রান্স জমনি রাশিয়া আমেরিকাকে ক্রমশ কিরূপ উগ্ৰ হিংস্রতার দিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে, কিরূপ প্ৰচণ্ড সংঘাতের মুখের কাছে দাঁড় করাইয়াছে, সভ্যনীতিকে প্রতিদিন কিরূপ বিপর্যস্ত করিয়া দিতেছে, তাহা দেখিলে প্রতিযোগিতাপ্রধান সভ্যতাকেই চরম সভ্যতা বলিতে কোনোমতেই প্ৰবৃত্তি হয় না। বল বুদ্ধি ও ঐশ্বর্য মনুষ্যত্বের একটা অঙ্গ হইতে পারে, কিন্তু শান্তি সামঞ্জস্য এবং মঙ্গলও কি তদপেক্ষা উচ্চতর অঙ্গ নহে? তাহার আদর্শ এখন কোথায় ? এখনকার কোন বণিকের আপিসে, কোন রণক্ষেত্রে ? কোন কালো কোর্তায়, লাল কোর্তায়, বা খাকি কোর্তায় সে সজ্জিত হইয়াছে ? সে ছিল প্ৰাচীন ভারতবর্ষের কুটিরপ্রাঙ্গণে শুভ্ৰ উত্তরীয় পরিয়া। সে ছিল ব্ৰহ্মপরায়ণ তপস্বীর স্তিমিত ধ্যানাসনে, সে ছিল ধর্মপরায়ণ আৰ্য গৃহস্থের কর্মমুখরিত যজ্ঞশালায়। দল বাধিয়া পূজা, কমিটি করিয়া শোক, বা চাদা করিয়া কৃতজ্ঞতাপ্রকাশ, এ আমাদের জাতির প্রকৃতিগত নহে। এ কথা আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে। এ গৌরবের অধিকার আমাদের নাই। কিন্তু তাই বলিয়া আমরা লজ্জা পাইতে প্ৰস্তুত নাহি। সংসারের সর্বত্রই হরণ-পূরণের নিয়ম আছে। আমাদের বা দিকে কমতি থাকিলেও ডান দিকে বাড়তি থাকিতে পারে। যে ওড়ে তাহার ডানা বড়ো, কিন্তু পা ছোটাে ; যে দৌড়ায় তাহার পা বড়ো, কিন্তু ऎन् न् । আমাদের দেশে আমরা বলিয়া থাকি, মহাত্মাদের নাম প্ৰাতঃস্মরণীয়। তাহা কৃতজ্ঞতার ঋণ শুধিবার জন্য নহে— ভক্তিভাজনকে দিবসারম্ভে যে ব্যক্তি ভক্তিভাবে স্মরণ করে তাহার মঙ্গল হয়— মহাপুরুষদের তাহাতে উৎসাহবৃদ্ধি হয় না, যে ভক্তি করে সে ভালো হয়। ভক্তি করা প্ৰত্যেকের প্রাত্যহিক কর্তব্য। কিন্তু তবে তো একটা লম্বা নামের মালা গাথিয়া প্ৰত্যহ আওড়াইতে হয় এবং সে মালা ক্রমশই বাড়িয়া চলে। তাহা হয় না। যথার্থ ভক্তিই যেখানে উদ্দেশ্য সেখানে মালা বেশি বাড়িতে পারে না। ভক্তি যদি নিজীব না হয় তবে সে জীবনের ধর্ম-অনুসারে গ্রহণ-বর্জন করিতে থাকে, কেবলই সঞ্চয় করিতে থাকে না। পুস্তক কতই প্রকাশিত হইতেছে, কিন্তু যদি অবিচারে সঞ্চয় করিবার প্রবৃত্তি না থাকে—যদি মনে করি কেবল যে বইগুলি যথার্থই আমার প্রিয়, যাহা আমার পক্ষে চিরদিন পড়িবার যোগ্য, সেইগুলিই রক্ষা করিব- তবে শত বৎসর পরমায়ু হইলেও আমার পাঠ্যগ্রন্থ আমার পক্ষে দুর্ভর হইয়া উঠে না। আমার প্রকৃতি যে মহাত্মাদের প্রত্যহস্মরণযোগ্য বলিয়া ভক্তি করে তাঁহাদের নাম যদি উচ্চারণ করি, তবে কতটুকু সময় লয় ? প্রত্যেক পাঠক যদি নিজের মনে চিন্তা করিয়া দেখেন তবে কয়টি নাম