পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভারতবর্ষ। Գ 8 Տ) আমাদের দেশে গৃহস্থ অতিথিকে সম্বোধন করিয়া বলে, “সমস্ত আপনারই— আপনারই ঘর, আপনারই বাড়ি।” ইহা অত্যুক্তি। ইংরেজ তাহার নিজের রান্নাঘরে প্রবেশ করিতে হইলে রাধুনিকে জিজ্ঞাসা করে, “ঘরে ঢুকিতে পারি কি ?” এ একরকমের অত্যুক্তি। স্ত্রী নুনের বাটি সরাইয়া দিলে ইংরেজ স্বামী বলে, “আমার ধন্যবাদ জানিবে।” ইহা অত্যুক্তি। নিমন্ত্রণকারীর ঘরে চর্বচোষ্য খাইয়া এবং বাধিয়া এ-দেশীয় নিমন্ত্রিত বলে “বড়ো পরিতোষ লাভ করিলাম, অর্থাৎ ‘আমার পরিতোষই তোমার পারিতোষিক’, তদুত্তরে নিমন্ত্রণকারী বলে “আমি কৃতাৰ্থ হইলাম। — ইহাকে অত্যুক্তি বলিতে পারো। আমাদের দেশে স্ত্রী স্বামীকে পত্রে “শ্ৰীচরণেষু পাঠ লিখিয়া থাকে, ইংরেজের কাছে ইহা অত্যুক্তি। ইংরেজ যাহাকে-তাহাকে পত্রে ‘প্ৰিয়’ সম্বোধন করে— অভ্যস্ত না হইয়া গেলে ইহা আমাদের কাছে অত্যুক্তি বলিয়া ঠেকিত। নিশ্চয়ই আরো এমন সহস্ৰ দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু এগুলি বাধা অত্যুক্তি, ইহারা পৈতৃক। দৈনিক ব্যবহারে আমরা নব নব অত্যুক্তি রচনা করিয়া থাকি, ইহাই প্ৰাচ্যজাতির প্রতি ভৎসনার কারণ। তালি এক হাতে বাজে না, তেমনি কথা দুজনে মিলিয়া হয়। শ্রোতা ও বক্তা যেখানে পরস্পরের ভাষা বোঝে সেখানে অত্যুক্তি উভয়ের যোগে আপনি সংশোধিত হইয়া আসে। সাহেব যখন চিঠির শেষে আমাকে লেখেন। yours truly, সত্যই তোমারই, তখন তাহার এই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার যখন নিজেকে আমার বাধ্যতম ভূত্য বলিয়া বৰ্ণনা করেন তখন অনায়াসে সে কথাটার ষোলো-আনা বাদ দিয়া তাহার উপরে আরো ষোলো-আনা কাটিয়া লইতে পারি। এগুলি বাধা দস্তুরের অত্যুক্তি, কিন্তু প্ৰচলিত ভাষাপ্রয়োগের অত্যুক্তি ইংরেজিতে बूट्रिबूद्धि SC& immensely, immeasurably, extremely, awfully, infinitely, absolutely, ever so much, for the life of me, for the world, unbounded, endless প্রভৃতি শব্দপ্রয়োগগুলি যদি সর্বত্র যথার্থভাবে লওয়া যায়। তবে প্ৰাচ্য অত্যুক্তিগুলি ইহজন্মে আর মাথা তুলিতে পারে না। বাহ্য বিষয়ে আমাদের কতকটা ঢিলামি আছে। এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে । বাহিরের জিনিসকে আমরা ঠিকঠাক-মতো দেখি না, ঠিকঠাক-মতো গ্ৰহণ করি না। যখন-তখন বাহিরের নয়কে আমরা ছয় এবং ছয়কে আমরা নয় করিয়া থাকি। ইচ্ছা করিয়া না করিলেও এ স্থলে অজ্ঞানকৃত পাপের ডবল দোষ—— একে পাপ তাহাতে অজ্ঞান। ইন্দ্রিয়কে এমন অলস এবং বুদ্ধিকে এমন অসাবধান করিয়া রাখিলে পৃথিবীতে আমাদের দুটি প্রধান নির্ভরকে একেবারে মাটি করা হয়। নিজেকেই ফাকি দেয়। যে-যে বিষয়ে আমাদের ফাকি আছে সেই- সেই বিষয়েই আমরা ঠকিয়া বসিয়া আছি। একচক্ষু হরিণ যে দিকে তাহার কানা চােখ ফিরাইয়া আরামে ঘাস খাইতেছিল। সেই দিক হইতেই ব্যাধের তীর তাহার বুকে বাজিয়াছে। আমাদের কানা চোখটা ছিল ইহলোকের দিকে— সেই তরফ হইতে আমাদের শিক্ষা যথেষ্ট হইয়াছে। সেই দিকের ঘা খাইয়া আমরা মরিলাম। কিন্তু স্বভাব না। যায় ম’লে । নিজের দোষ কবুল করিলাম, এবার পরের প্রতি দোষারোপ করিবার অবসর পাওয়া যাইবে। অনেকে এরূপ চেষ্টাকে নিন্দা করেন, আমরাও করি। কিন্তু যে লোক বিচার করে অন্যে তাহাকে বিচার করিবার অধিকারী। সে অধিকারটা ছাড়িতে পারিব না। তাহাতে পরের কোনো উপকার হইবে বলিয়া আশা করি না— কিন্তু অপমানের দিনে যেখানে যতটুকু আত্মপ্রসাদ পাওয়া যায় তাহা ছাড়িয়া দিতে পারিব না। আমরা দেখিয়াছি, আমাদের অত্যুক্তি অলস বুদ্ধির বাহ্য প্রকাশ। তা ছাড়া সুদীর্ঘকাল পরাধীনতাবশত চিত্তবিকারেরও হাত দেখিতে পাই। যেমন আমাদিগকে যখন-তখন, সময়ে-অসময়ে, উপলক্ষ থাক বা না থাক, চীৎকার করিয়া বলিতে হয়—আমরা রাজভক্ত। অথচ ভক্তি করিব কাহাকে