পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ー (?br রবীন্দ্র-রচনাবলী যুরোপ বলে, বাসনা যে কোনাে পরিণামে লইয়া যায় না, তাহা নিয়তই যে আমাদের প্রয়াসকে উদ্রিক্ত করিয়া রাখে, ইহাই তাহার গৌরব । যুরোপ বলে, প্ৰাপ্তি নহে— সন্ধানই আনন্দ। ভারতবর্ষ বলে, তোমরা যাহাকে প্ৰাপ্তি বল তাহাতে আনন্দ নাই বটে ; কারণ সে প্ৰাপ্তির মধ্যে আমাদের সন্ধানের শেষ নাই, সে প্ৰাপ্তি আমাদিগকে অন্য প্ৰাপ্তির দিকে টানিয়া লইয়া যায়। প্রত্যেক প্ৰাপ্তিকেই পরিণাম বলিয়া ভ্ৰম করি এবং তাহার পরে দেখিতে পাই, তাহা পরিণাম নহে। যে প্ৰাপ্তিতে আমাদের শান্তি, আমাদের সন্ধানের শেষ, এই ভ্ৰমে তাহা হইতে আমাদিগকে ভ্ৰষ্ট করে, আমাদিগকে কোনোমতেই মুক্তি দেয় না। যে বাসনা সেই মুক্তির বিরোধী সেই বাসনাকে আমরা হীনবল করিয়া দিব। আমরা কর্মকে জয়ী করিব না, কমের উপরে জয়ী হইব । আমাদের গৃহধর্ম, আমাদের সন্ন্যাসধর্ম, আমাদের আহারবিহারের সমস্ত নিয়ম-সংযম, আমাদের বৈরাগী ভিক্ষুকের গান হইতে তত্ত্বজ্ঞানীদের শাস্ত্রব্যাখ্যা পর্যন্ত, সর্বত্রই এই ভাবের আধিপত্য। চাষা হইতে পণ্ডিত পর্যন্ত সকলেই বলিতেছে, “আমরা দুর্লভ মানবজন্ম লাভ করিয়াছি বুদ্ধিপূর্বক মুক্তির পথ গ্রহণ করিবার জন্য, সংসারের অন্তহীন আবর্তের আকর্ষণ হইতে বহির্গত হইয়া পড়িবার জন্য ।” সংস্কৃত ভাষায় “ভব’ শব্দের ধাতুগত অর্থ হওয়া’। ‘ভবের বন্ধন অর্থাৎ হওয়ার বন্ধন কাটিতে চাই। যুরোপ খুব করিয়া হইতে চায়, আমরা একেবারেই না-হইতে চাই। এমনতরো ভয়ংকর স্বাধীনতার চেষ্টা ভালো কি মন্দ, তাহার মীমাংসা করা বড়ো কঠিন ! এরূপ অনাসক্তি যাহাদের স্বভাবসিদ্ধ আসক্ত লোকের সংঘাতে তাহদের বিপদ ঘটিতে পারে, এমন-কি, তাহাদের মারা যাইবার কথা। অপর পক্ষে বলিবার কথা এই যে, মীরা-বাচাই সার্থকতার চরম পরীক্ষা নয়। ফ্রান্স তাহার ভীষণ রাষ্ট্রবিপ্লবে স্বাধীনতার বিশেষ একটি আদর্শকে জয়ী করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, সেই চেষ্টায় প্রায় তাহার আত্মহত্যার জো হইয়াছিল–– যদিই। সে মরিত তবু কি তাহার গৌরব কম হইত ? একজন মজ্জামান ব্যক্তিকে উদ্ধার করিবার চেষ্টায় একটা লোক প্রাণ দিল, আর-একজন তীরে দাড়াইয়া থাকিল— তাই বলিয়া কি উদ্ধারচেষ্টাকে মৃত্যুপরিণামের দ্বারা বিচার করিয়া ধিককার দিতে হইবে ? পৃথিবীতে আজ সকল দেশেই বাসনার অগ্নিকে প্রবল ও কর্মের দৌরাত্মাকে উৎকট করিয়া তুলিতেছে ; আজ ভারতবর্ষ যদি— জড়ভাবে নহে, মূঢ়ভাবে নহে- জাগ্ৰত সচেতনভাবে বাসনাবন্ধ-মুক্তির আদর্শকে, শান্তির জয়পতাকাকে, এই পৃথিবীব্যাপী রক্তাক্ত বিক্ষোভের উর্ধেব অবিচলিত দৃঢ়হস্তে ধারণ করিয়া মরিতে পারিত তবে, অন্য সকলে তাহাকে যতই ধিককার দিক, মৃত্যু তাহাকে অপমানিত করিত না ! কিন্তু এ তর্ক এখানে বিস্তার করিবার স্থান নহে। মোট কথা এই যুরোপের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের ইতিহাসের ঐক্য হইতেই পারে না, এ কথা আমরা বারংবার ভুলিয়া যাই । যে ঐক্যসূত্রে ভারতবর্ষের অতীত ভবিষ্যৎ বিধৃত তাহাকে যথার্থভাবে অনুসরণ করিতে গেলে আমাদের শাস্ত্ৰ, পুরাণ, কাব্য, সামাজিক অনুষ্ঠান প্রভৃতির মধ্যে প্রবেশ করিতে হয়— রাজবংশাবলীর জন্য বৃথা আক্ষেপ করিয়া বেড়াইলে বিশেষ লাভ নাই। যুরোপীয় ইতিহাসের আদর্শে ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনা করিতে হইবে এ কথা আমাদিগকে একেবারেই ভুলিয়া যাইতে হইবে। এই ইতিহাসের বহুতরো উপকরণ যে বৌদ্ধশাস্ত্রের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া আছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। আমাদের দেশে বহুদিন অনাদৃত এই বৌদ্ধশাস্ত্ৰ য়ুরোপীয় পণ্ডিতগণ উদ্ধার করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছেন। আমরা তঁহাদের পদানুসরণ করিবার প্রতীক্ষায় বসিয়া আছি। ইহাই আমাদের দেশের পক্ষে দারুণ্যতম লজার কারণ। দেশের প্রতি আমাদের সমস্ত ভালোবাসাই কেবল গবৰ্মেন্টের দ্বারে ভিক্ষাকার্যের মধ্যেই আবদ্ধ- আর-কোনো দিকেই তাহার কোনো গতি নাই। সমস্ত দেশে পাচজন লোকও কি বৌদ্ধশাস্ত্ৰ উদ্ধার করাকে চিরজীবনের ব্ৰতস্বরূপে গ্ৰহণ করিতে পারেন না ? এই বৌদ্ধশাস্ত্রের পরিচয়ের অভাবে ভারতবর্ষের সমস্ত ইতিহাস কানা হইয়া আছে, এ কথা মনে করিয়াও কি দেশের জনকয়েক তরুণ যুবার উৎসাহ এই পথে ধাবিত হইবে না।