পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চরিত্ৰপূজা १११ করিয়া। তবে পড়িতে যাইবার অবসর পাইতেন ; পাক করিতে করিতে ও স্কুলে যাইবার সময় পথে চলিতে চলিতে পাঠানুশীলন করিতেন। এই তো অবস্থা। এ দিকে ছুটির সময় যখন জল খাইতে যাইতেন তখন স্কুলের ছাত্র যাহারা উপস্থিত থাকিত তাহাদিগকে মিষ্টান্ন খাওয়াইতেন। স্কুল হইতে মাসিক যে বৃত্তি পাইতেন ইহাতেই তাহা ব্যয় হইত। আবার দরোয়ানের নিকট ধার করিয়া দরিদ্র ছাত্ৰাদিগকে নূতন বস্ত্ৰ কিনিয়া দিতেন। পূজার ছুটির পর দেশে গিয়া “দেশস্থ যে সকল লোকের দিনপাত হওয়া দুষ্কর দেখিতেন, তাহাদিগকে যথাসাধ্য সাহায্য করিতে ক্ষান্ত থাকিতেন না। অন্যান্য লোকের পরিধেয় বস্ত্র না থাকিলে গামছা পরিধান করিয়া, নিজের বস্ত্রগুলি তাহাদিগকে বিতরণ করিতেন।” ১ যে অবস্থায় মানুষ নিজের নিকট নিজে প্রধান দয়ার পাত্র সে অবস্থায় ঈশ্বরচন্দ্ৰ অন্যকে দয়া করিয়াছেন। তাহার জীবনে প্রথম হইতে ইহাই দেখা যায় যে, তাহার চরিত্র সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে ক্ৰমাগতই যুদ্ধ করিয়া জয়লাভ করিয়াছে। তাহার মতো অবস্থাপন্ন ছাত্রের পক্ষে বিদ্যালাভ করা পরম দুঃসাধ্য, কিন্তু এই গ্ৰাম্য বালক শীর্ণ খর্ব দেহ এবং প্রকাণ্ড মাথা লইয়া আশ্চর্য অল্পকালের মধ্যেই বিদ্যাসাগর উপাধি প্ৰাপ্ত হইয়াছেন। তাহার মতো দরিদ্রাবস্থার লোকের পক্ষে দান করা, দয়া করা বড়ো কঠিন ; কিন্তু তিনি যখন যে অবস্থাতেই পডিয়াছেন নিজের কোনোপ্রকার অসচ্ছলতায় র্তাহাকে পরের উপকার হইতে বিরত করিতে পারে নাই, এবং অনেক মহৈশ্বর্যশালী রাজা রায়বাহাদুর প্রচুর ক্ষমতা লইয়া যে উপাধি লাভ করিতে পারে নাই এই দরিদ্র পিতার দরিদ্র সন্তান সেই ‘দয়ার সাগর’ নামে বঙ্গদেশে চিরদিনের জন্য বিখ্যাত হইয়া রহিলেন । কলেজ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া বিদ্যাসাগর প্রথমে ফোর্ট উইলিয়ম -কলেজের প্রধান পণ্ডিত ও পরে সংস্কৃতকলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত হন। এই কার্যোপলক্ষে তিনি যে-সকল ইংরাজ প্ৰধান কর্মচারীদের সংস্রবে। আসিয়াছিলেন সকলেরই পরম শ্রদ্ধা ও প্রীতি –ভাজন হইয়াছিলেন । আমাদের দেশে প্ৰায় অনেকেই নিজের এবং স্বদেশের মর্যাদা নষ্ট করিয়া ইংরাজের অনুগ্রহ লাভ করেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর সাহেবের হস্ত হইতে শিরোপা লইবার জন্য কখনো মাথা নত করেন নাই ; সম্মান ক্রয় করিতে চেষ্টা করেন নাই। একটা উদাহরণে তাহার প্রমাণ হইবে। একবার তিনি কার্যোপলক্ষে হিন্দুকলেজের প্রিন্সিপল কার-সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলেন। সভ্যতাভিমানী সাহেব তাহার বুট-বেষ্টিত দুই পা টেবিলের উপরে উর্ধর্বগামী করিয়া দিয়া, বাঙালি ভদ্রলোকের সহিত ভদ্রতরক্ষা করা বাহুল্য বোধ করিয়াছিলেন। কিছু দিন পরে ঐ কার-সাহেব কাৰ্যবশত সংস্কৃতকলেজে চরণযুগল টেবিলের উপর প্রসারিত করিয়া এই অহংকৃত ইংরাজ অভ্যাগতের সহিত আলাপ করিলেন। বোধ করি শুনিয়া কেহ বিস্মিত হইবেন না, সাহেব নিজের এই অবিকল অনুকরণ দেখিয়া সন্তোষলাভ করেন নাই । ইতিমধ্যে কলেজের কার্যপ্ৰণালী সম্বন্ধে তাহার সহিত কর্তৃপক্ষের মতান্তর হওয়ায় ঈশ্বরচন্দ্ৰ কর্মত্যাগ করিলেন। সম্পাদক রসময় দত্ত এবং শিক্ষাসমাজের অধ্যক্ষ ময়েট সাহেব অনেক উপরোধ-অনুরোধ করিয়াও কিছুতেই তাহার পণভঙ্গ করিতে পারিলেন না। আত্মীয়-বান্ধবেরা তাহাকে করিয়া দিন চালাইব ।” তখন বাসায় প্রায় কুড়িটি বালককে তিনি অন্নবস্ত্ৰ দিয়া অধ্যয়ন করাইতেছিলেন— তাহাদের কাহাকেও বিদায় করিলেন না। র্তাহার পিতা পূর্বে চাকরি করিতেন— বিদ্যাসাগরের সবিশেষ অনুরোধে কাৰ্য্যত্যাগ করিয়া বাড়ি বসিয়া সংসারখরচের টাকা পাইতেছিলেন। বিদ্যাসাগর কাজ ছাড়িয়া দিয়া প্ৰতি মাসে ধার করিয়া পঞ্চাশ টাকা বাড়ি পাঠাইতে ১। সহােদর শাস্তুচন্দ্ৰ বিদ্যারত্ব -প্ৰণীত বিদ্যাসাগরজীবনচরিত