পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চারিত্রিপূজা Գ Գ Տ হন নাই। বর্ধমান-বাস-কালে তিনি তাহার প্রতিবেশী দরিদ্র মুসলমানগণকে আত্মীয়নির্বিশেষে যত্ন করিয়াছিলেন। শ্ৰীযুক্ত শম্ভুচন্দ্ৰ বিদ্যারত্ন মহাশয় তাহার সহােদরের জীবনচরিতে লিখিতেছেন“অন্নসত্রে ভোজনকারিণী স্ত্রীলোকদের মস্তকের কেশগুলি তৈলাভাবে বিরূপ দেখাইত। অগ্রজ মহাশয় তাহা অবলোকন করিয়া দুঃখিত হইয়া তৈলের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, প্রত্যেককে দুই পলা করিয়া তৈল দেওয়া হইত। যাহারা তৈল বিতরণ করিত, তাহারা, পাছে মুচি, হাড়ী, ডোম প্রভৃতি অপকৃষ্ট জাতীয় স্ত্রীলোক স্পর্শ করে, এই আশঙ্কায় তফাৎ হইতে তৈল দিত, ইহা দেখিয়া অগ্রজ মহাশয় স্বয়ং উক্ত অপকৃষ্ট ও অস্পশ্য জাতীয় স্ত্রীলোকদের মস্তকে তৈল মাখাইয়া দিতেন।” এই ঘটনাশ্রবণে আমাদের হৃদয় যে ভক্তিতে উচ্ছসিত হইয়া উঠে তাহা বিদ্যাসাগরের দয়া অনুভব করিয়া নহে। কিন্তু তাহার দয়ার মধ্য হইতে যে-একটি নিঃসংকোচ বলিষ্ঠ মনুষ্যত্ব পরিস্ফুট হইয়া উঠে তাহা দেখিয়া, আমাদের এই নীচজাতির প্রতি চিরাভ্যস্ত-ঘূণা-প্রবণ মনও আপন নিগৃঢ়মানবধর্মবিশত ভক্তিতে আকৃষ্ট না হইয়া থাকিতে পারে না। তাহার কারুণ্যের মধ্যে যে পৌরুষের লক্ষণ ছিল তাহার অনেক উদাহরণ দেখা যায়। আমাদের দেশে আমরা র্যাহাদিগকে ভালোমানুষ অমায়িকপ্রকৃতি বলিয়া প্ৰশংসা করি, সাধারণত তাহাদের চক্ষুলজা বেশি। অর্থাৎ কর্তব্যস্থলে তাহারা কাহাকেও বেদনা দিতে পারেন না। বিদ্যাসাগরের দয়ায় সেই কাপুরুষতা ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র যখন কলেজের ছাত্র ছিলেন তখন তাহাদের বেদান্ত-অধ্যাপক শদ্ভুচন্দ্ৰ বাচস্পতির সহিত তাহার বিশেষ প্রীতিবন্ধন ছিল। বাচস্পতিমহাশয় বুদ্ধবয়সে পুনরায় দারপরিগ্ৰহ করিবার ইচ্ছা করিয়া তাহার প্ৰিয়তম ছাত্রের মত জিজ্ঞাসা করিলে ঈশ্বরচন্দ্ৰ প্ৰবল আপত্তি প্রকাশ করিলেন। গুরু বারংবার কাকুতিমিনতি করা সত্ত্বেও তিনি মতপরিবর্তন করিলেন না। তখন বাচস্পতিমহাশয় ঈশ্বরচন্দ্রের নিষেধে কৰ্ণপাত না করিয়া এক সুন্দরী বালিকাকে বিবাহপূর্বক তাহাকে আশু বৈধব্যের তটদেশে আনয়ন করিলেন। শ্ৰীযুক্ত চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তাহার বিদ্যাসাগর গ্রন্থে এই ব্যাপারের যে পরিণাম বৰ্ণনা করিয়াছেন তাহা এই স্থলে উদধূত করি। — ‘বাচস্পতিমহাশয় ঈশ্বরচন্দ্রের হাত ধরিয়া বলিলেন, “তোমার মাকে দেখিয়া যাও।” এই বলিয়া দাসীকে নববধূর অবগুণ্ঠন উন্মোচন করিতে বলিলেন, তখন বাচস্পতি মহাশয়ের নববিবাহিত পত্নীকে দেখিয়া ঈশ্বরচন্দ্ৰ অশ্রুসংবরণ করিতে পারিলেন না। সেই জননীস্থানীয়া বালিকাকে দর্শন করিয়া ও মহাশয় ‘অকল্যাণ করিস না রে বলিয়া তাহাকে লইয়া বাহির বাটীতে আসিলেন এবং নানাপ্রকার শাস্ত্রীয় উপদেশের দ্বারা ঈশ্বরচন্দ্রের মনের উত্তেজনা ও হৃদয়ের আবেগ রোধ করিতে ও তাহাকে প্ৰবোধ দিতে প্ৰয়াস পাইতে লাগিলেন। পরিশেষে ঈশ্বরচন্দ্রকে কিঞ্চিৎ জল খাইতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু পাষাণাতুল্য কঠিন প্ৰতিজ্ঞাপরায়ণ ঈশ্বরচন্দ্ৰ জলযোগ করিতে সম্পূর্ণরূপে অসম্মত হইয়া বলিলেন, ‘এ, ভিটায়, আর কখনও জলস্পর্শ করিব না’ ৷ ” বিদ্যাসাগরের হৃদয়বৃত্তির মধ্যে যে বলিষ্ঠতা দেখা যায় তাহার বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যেও তাহার পরিপূর্ণ প্রভাব প্রকাশ পায়। বাঙালির বুদ্ধি সহজেই অত্যন্ত সূক্ষ্ম। তাহার দ্বারা চুল চেরা যায়, কিন্তু বড়ো বড়ো গ্ৰন্থি ছেদন করা যায় না। তাহা সুনিপুণ, কিন্তু সবল নহে। আমাদের বুদ্ধি ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার মতো অতিসূক্ষ্ম তর্কের বাহাদুরিতে ছোটে ভালো, কিন্তু কর্মের পথে গাড়ি লইয়া চলে না। বিদ্যাসাগর যদিচ ব্ৰাহ্মণ এবং ন্যায়শাস্ত্ৰও যথোচিত অধ্যয়ন করিয়াছিলেন তথাপি যাহাকে বলে কাণ্ডজ্ঞান সেটা তাহার যথেষ্ট ছিল। এই কাণ্ডজ্ঞানটি যদি না থাকিত, তবে যিনি এক সময় ছোলা ও বাতাসা জলপান করিয়া পাঠশিক্ষা করিয়াছিলেন তিনি অকুতোভয়ে চাকরি ছাড়িয়া দিয়া স্বাধীন জীবিকা অবলম্বন করিয়া জীবনের মধ্যপথে সচ্ছল। স্বচ্ছন্দাবস্থায় উত্তীর্ণ হইতে পারিতেন না। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, দয়ার অনুরোধে যিনি ভুরি ভুরি স্বাৰ্থত্যাগ করিয়াছেন, যিনি স্বার্থের অনুরোধে আপন মহােচ্চ আত্মসম্মানকে মুহুর্তের জন্য তিলমাত্র অবনত হইতে দেন নাই, যিনি আপনার ন্যায়সংকল্পের ঋজুরেখা হইতে কোনো মন্ত্রণায় কোনো প্রলোভনে দক্ষিণে বামে কেশাগ্ৰপরিমাণ হেলিতে চাহেন নাই, তিনি