পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Ե-8 রবীন্দ্র-রচনাবলী লাভক্ষতির নিকট বাহ্য সুখদুঃখ লাভক্ষতি কিছুই নহে। আমাদের বহিজীবনেরও একটা লক্ষা আছে, তাহাকে সমস্ত জড়াইয়া এক কথায় স্বাৰ্থ বলা যায়। খাওয়া-পর-শোওয়া, কাজকর্ম করা- সমস্ত স্বার্থের অঙ্গ। ইহাই আমাদের বহিজীবনের মূলগ্রান্থ। মননের দ্বারা আমরা যে অস্তজীবন লাভ করি তাহার মূল লক্ষ্য পরমার্থ। এই আম-মহল ও খাস-মহলের দুই কর্তা— স্বার্থ ও পরমার্থ। ইহাদের সামঞ্জস্যসাধন করিয়া চলাই মানবজীবনের আদর্শ। কিন্তু মধ্যে মধ্যে সংসারের বিপাকে পড়িয়া যে অবস্থায় ‘অর্ধাং ত্যজাতি পণ্ডিতঃ তখন পরমার্থকে রাখিয়া স্বার্থই পরিত্যাজ্য, এবং র্যাহার মনোজীবন প্ৰবল তিনি অবলীলাক্রমে সেই কাজ করিয়া থাকেন। অধিকাংশের মন সজীব নয় বলিয়া শাস্ত্রে এবং লোকাচারে আমাদের মনঃপুত্তলী যন্ত্রে দম দিয়া তাহাকে একপ্রকার কৃত্ৰিম গতি দান করে। কেবল সেই জোরে আমরা বহুকাল ধরিয়া দয়া করি না, দান করি— ভক্তি করি না, পূজা করি— চিন্তা করি না, কর্ম করি— বোধ করি না, অথচ সেইজন্যই কোনটা ভালো ও কোনটা মন্দ তাহা অত্যন্ত জোরের সহিত অতিশয় সংক্ষেপে চোখ বুজিয়া ঘোষণা করি। ইহাতে সজীব-দেবতা-স্বরূপ পরমার্থ আমাদের মনে জাগ্ৰত না থাকিলেও তাহার জড়প্রতিমা কোনোমতে আপনার ঠাট বজায় রাখে। এই নিজীবতা ধরা পড়ে বাধা নিয়মের নিশ্চেষ্ট অনুসরণ দ্বারা। যে সমাজে একজন অবিকল আর-একজনের মতো এবং এক কালের সহিত অন্য কালের বিশেষ প্ৰভেদ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না, সে সমাজে পরমার্থ সজীব নাই এবং মননক্রিয়া একেবারে বন্ধ হইয়া গেছে। এ কথা নিশ্চয় বলা যাইতে পারে । আমাদের দেশের কবি তাই বলিয়াছেন ; গতানুগতিকে লোকো ন লোকঃ পারমার্থিকঃ । অর্থাৎ, লোক গতানুগতিক। লোক যে পারমার্থিক নহে এবং পারমার্থিক লোক গতানুগতিক হইয়া থাকিতে পারেন না, কবি এই নিগঢ়ি কথাটি অনুভব করিয়াছেন। বিদ্যাসাগর আর যাহাঁই হউন, গতানুগতিক ছিলেন না। কেন ছিলেন না। তাহার প্রধান কারণ, মননজীবনই তাহার মুখ্য জীবন ছিল। অবশ্য, সকল দেশেই গতানুগতিকের সংখ্যা বেশি। কিন্তু যে দেশে স্বাধীনতার স্ফর্তি ও বিচিত্র কর্মের চাঞ্চল্য সর্বদা বর্তমান সেখানে লোকসমাজমস্থনে সেই অমৃত উঠে যাহাতে মনকে জীবনদান তথাপি সকলেই জানেন, কালাইলের ন্যায় লেখক তাহদের দেশের সাধারণ জনসমাজের অন্ধ মৃঢ়তাকে কিরূপ সুতীব্র ভৎসনা করিয়াছেন। কার্লাইল যাহাকে hero অর্থাৎ বীর বলেন, তিনি কে — The hero is he who lives in the inward sphere of things, in the True, Divine and Eternal, which exists always, unseen to most, under the Temporary, Trivial; his being is in that ; he declares that abroad; by act or speech, as it may be, in declaring himself aborOad অর্থাৎ, তিনিই বীর যিনি বিষয়পুঞ্জের অন্তরতর রাজ্যে সত্য এবং দিব্য এবং অনন্তকে আশ্রয় করিয়া আছেন— যে সত্য, দিব্য ও অনন্ত পদার্থ অধিকাংশের অগোচরে চারি দিকের তুচ্ছ এবং ক্ষণিক ব্যাপারের অভ্যস্তরে নিত্যকাল বিরাজ করিতেছেন ; সেই অন্তররাজ্যেই তাহার অস্তিত্ব ; কর্ম-দ্বারা অথবা বাক্য-দ্বারা নিজেকে বাহিরে প্রকাশ করিয়া তিনি সেই অন্তররাজ্যকেই বাহিরে বিস্তার করিতেছেন। কার্লাইলের মতে ইহারা কাপড় ঝুলাইবার আলনা বা হজম করিবার যন্ত্র নহেন, ইহারা সজীব মনুষ্য, অর্থাৎ, সেই একই কথা—স জীবতি মনাে যস্য মননেন হি জীবতি । অথবা অন্য কবির ভাষায়,