পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ab-br রবীন্দ্র-রচনাবলী আমরা নিজে জোটাইতে পারি। যদি তেমনই ঘটে। তবে পাকের উপর চলিব, বরফের উপরেই চলিব, কিন্তু উন্নতভাবে চলিব ; প্রকৃতি আমাদিগকে যে সত্য দিয়াছেন তাঁহারই উপর চলিব ; অপরকে যাহা দিয়াছেন তাহারই নকলের উপর চলিব না ।” কার্লাইল যাহা লিখিয়াছেন তাহার ঘটনা সম্বন্ধে না মিলুক, তাহার মর্মকথাটুকু বিদ্যাসাগরে অবিকল খাটে। তিনি গতানুগতিক ছিলেন না, তিনি স্বতন্ত্র, সচেতন, পারমার্থিক ছিলেন ; শেষ দিন পর্যন্ত র্তাহার জুতা তাহার নিজেরই চটিজুতা ছিল। আমাদের কেবল আক্ষেপ এই যে, বিদ্যাসাগরের বসওয়েল কেহ ছিল না; তাহার মনের তীক্ষতা, সবলতা, গভীরতা ও সহৃদয়তা তাহার বাক্যালাপের মধ্যে প্রতিদিন অজস্র বিকীর্ণ হইয়া গেছে, অদ্য সে আর উদ্ধার করিবার উপায় নাই। বসওয়েল না। থাকিলে জনসনের মনুষ্যত্ব লোকসমাজে স্থায়ী আদর্শ দান করিতে পারিত না। সৌভাগ্যক্রমে বিদ্যাসাগরের মনুষ্যত্ব র্তাহার কাজের মধ্যে আপনার ছাপ রাখিয়া যাইবে- কিন্তু তাহার অসামান্য মনস্বিতা, যাহা তিনি অধিকাংশ সময়ে মুখের কথায় ছড়াইয়া দিয়াছেন, তাহা কেবল অপরিস্ফুট জনশ্রুতির মধ্যে অসম্পূর্ণ আকারে বিরাজ করিবে। অগ্রহায়ণ ১৩০৫ রামমোহন রায় রাজা রামমোহন রায়ের স্মরণার্থ সভায় ১২৯১ সালের ৫ মাঘে সিটি কলেজ গৃহে পঠিত সাধারণত আমরা প্ৰতিদিন গুটিকতক ছোটাে ছোটাে কাজ লইয়াই থাকি ; মাকড়সার মতো নিজের ভিতর হইতে টানিয়া টানিয়া আমাদের চারি দিকে স্বার্থের জাল নির্মাণ করি ও স্ফীত হইয়া তাহারই মাঝখানটিতে ঝুলিতে থাকি ; সমস্ত জীবন দৈনন্দিন খুঁটিনাটির মধ্যে সমাহিত হইয়া অন্ধকার ও সংকীর্ণতার গর্ভে স্বচ্ছন্দসুখ অনুভব করি। আমাদের প্রতিদিন পূর্বদিনের পুনরাবৃত্তি মাত্র, আমাদের ক্ষুদ্র জীবন একটি ধারাবাহী উন্নতির কাহিনী নহে। সেই প্রতিদিবসের উদরপূর্তি, প্রতিরাত্রের নিদ্ৰা— বৎসরের মধ্যে এই ঘটনা ও ইহারই আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানগুলিরই তিনশো পয়ষট্টি বার করিয়া পুনরাবর্তন— এই তো আমাদের জীবন, ইহাতে আমাদের নিজের প্রতি শ্রদ্ধা হয় না— অহংকার ও আত্মাভিমানের অভাব নাই বটে, কিন্তু আপনাদের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা নাই। একপ্রকার নিকৃষ্টজাতীয় জীবাণু আছে, সে কেবল গতিবিশেষ অবলম্বন করিয়া ঘুরিতেই জানে; সে সমস্ত জীবন একই ঘুরন ঘুরিতেছে। তাহার সহিত আমাদের বেশি প্ৰভেদ দেখিতে পাই না। আমাদের আহ্নিক গতি আছে, বার্ষিক গতি নাই- আমরা নিজের চারি দিকে ঘুরিতেছি, নিজের নাভিকুণ্ডল প্ৰদক্ষিণ করিতেছি, কিন্তু অনন্তজীবনের কক্ষপথে এক পা অগ্রসর হইতেছি না। এই পরম কৌতুকাবহ আত্মপ্ৰদক্ষিণ-দৃশ্য চতুর্দিকে দেখা যাইতেছে- সকলে মাটির উপরে বিন্দুমাত্র চিহ্ন রচনা করিয়া লাটিমের ন্যায় সূচ্যগ্র-পরিমাণ-ভূমির মধ্যেই জীবনের সুদীর্ঘ ভ্ৰমণ নিঃশেষ করিয়া দিতেছে। প্রতিদিন চারি দিকে ইহাই দেখিয়া মনুষ্যত্বের উপরে আমাদের বিশ্বাস হ্রাস হইয়া যায়, সুতরাং মনুষ্যত্বের গুরুতর কর্তব্য সাধন করিবার বল চলিয়া যায়। এইজন্য মহাত্মাদের প্রতি মাঝে মাঝে দৃষ্টিপাত করা আমাদের নিতান্ত আবশ্যক। মহাত্মাদের জীবন আলোচনা করিলে মনুষ্যত্ব যে কী তাহা বুঝিতে পারি, “আমরা মানুষ বলিলে যে কতখানি বলা হয় তাহা উপলব্ধি করিতে পারি, জানিতে পারি যে আমরা কেবল অস্থিচর্মনির্মিত একটা আহার করিবার যন্ত্র মাত্র নই, আমাদের সুমহৎ কুলমর্যাদার খবর পাইয়া থাকি। আমরা যে আমাদের চেয়ে ঢের বড়ো, অর্থাৎ মনুষ্য, সাধারণ মানুষদের চেয়ে যে অনেক পরিমাণে