পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܓ ܬ d ভস্মের মধ্যে যে অগ্নিকণিকা অবশিষ্ট আছে তাহা ভারতবাসীর হৃদয়ের গৃঢ় অভ্যন্তরে নিহিত, সে অগ্নি প্ৰজ্বলিত হইয়া উঠিলে সে আর নিভিবে না। এত বল এত ধৈৰ্য নহিলে তিনি রাজা কিসের ? দিল্লির সম্রাট তাহাকে রাজোপাধি দিয়াছেন, কিন্তু দিল্লির সম্রাটের সম্রাট তাহাকে রাজা করিয়া পাঠাইয়াছেন। ভারতবর্ষে বঙ্গসমাজের মধ্যে তিনি তাহার রাজসিংহাসন প্ৰতিষ্ঠা করিয়াছেন। তবে আমরা কি তাহাকে সম্মান করিব না ? রামমোহন রায় যখন ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেন তখন এখানে চতুর্দিকে কালরাত্রি অন্ধকার রাজ করিতেছিল। আকাশে মৃত্যু বিচরণ করিতেছিল। মিথ্যা ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে তাহাকে সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল। মিথ্যা ও মৃত্যু –নামক মায়াবী রাজাদের প্রকৃত বল নাই, অমোঘ অস্ত্ৰ নাই, কোথাও তাহাদের দাড়াইবার স্থল নাই, কেবল নিশীথের অন্ধকার ও একপ্রকার অনিৰ্দেশ্য বিভীষিকার উপরে তাহাদের সিংহাসন প্রতিষ্ঠিত। আমাদের অজ্ঞান— আমাদের “হৃদয়ের দুর্বলতাই তাহাদের বল। অতি বড়ো ভীরুও প্ৰভাতের আলোতে প্রেতের নাম শুনিলে হাসিতে পারে, কিন্তু অন্ধকার নিশীথিনীতে একটি শুষ্ক পত্রের শব্দ একটি তৃণের ছায়াও অবসর পাইয়া আমাদের হৃদয়ে নিষ্ঠুর আধিপত্য করিতে থাকে। যথার্থ দাসুভয় অপেক্ষা সেই মিথ্যা অনিৰ্দেশ্য ভয়ের শাসন প্রবলতর। অজ্ঞানের মধ্যে মানুষ যেমন নিরুপায়, যেমন অসহায়, এমন আর কোথায় ? রামমোহন রায় যখন জাগ্রত হইয়া ব্যঙ্গসমাজের চারি দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন তখন বঙ্গসমাজ সেই প্ৰেতভূমি ছিল। তখন শ্মশানস্থলে প্রাচীনকালের জীবন্ত হিন্দুধর্মের প্ৰেতমাত্র রাজত্ব করিতেছিল। তাহার জীবন নাই, অস্তিত্ব নাই, কেবল অনুশাসন ও ভয় আছে মাত্র। সেই নিশীথে, শ্মশানে, সেই ভয়ের বিপক্ষে “মা ভৈঃ’ শব্দ উচ্চারণ করিয়া যিনি একাকী অগ্রসর হইয়াছিলেন তাহার মাহাত্ম্য আমরা আজিকার এই দিনের আলোকে হয়তো ঠিক অনুভব করিতে পারিব না। যে ব্যক্তি সাপবিধ করিতে অগ্রসর হয় তাহার কেবলমাত্র জীবনের আশঙ্কা থাকে, কিন্তু যে ব্যক্তি বাস্তুসপ মারিতে যায় তাহার জীবনের আশঙ্কার অপেক্ষা অনিৰ্দেশ্য অমঙ্গলের আশঙ্কা বলবত্তর হইয়া উঠে। তেমনি রামমোহন রায়ের সময়ে হিন্দুসমাজের ভগ্নাভিত্তির সহস্র ছিদ্রে সহস্ৰ বাস্তু-অমঙ্গল উত্তরোত্তর পরিবর্ধমান বংশপরম্পরা লইয়া প্ৰাচীনতা ও জড়তার প্রভাবে অতিশয় স্থূলকায় হইয়া উঠিতেছিল। রামমোহন রায় সমাজকে এই সহস্ৰ নাগপাশবন্ধন হইতে মুক্ত করিতে নিৰ্ভয়ে অগ্রসর হইলেন। কিন্তু এই নিদারুণ বন্ধন অনুরাগবন্ধনের ন্যায় সমাজকে জড়াইয়াছিল, এইজন্য সমস্ত বঙ্গসমাজ আর্তনাদ করিয়া রামমোহন রায়ের বিরুদ্ধে উত্থান করিল। আজি আমাদের বালকেরাও সেই সকল মৃতসপের উপরে হাস্যমুখে পদাঘাত করে, আমরা তাহাদিগকে নির্বিষ টোড়া সাপ বলিয়া উপহাস করি— ইহাদের প্রবল প্ৰতাপ, ইহাদের চক্ষের মোহ-আকর্ষণ, ইহাদের সুদীর্ঘ লাঙ্গুলের ভীষণ আলিঙ্গনের কথা আমরা বিস্মৃত হইয়াছি। একবার ভাঙচুর করিতে আরম্ভ করিলে একটা নেশা চড়িয়া যায়। সৃজনের যেমন আনন্দ আছে প্ৰলয়ের তেমনি একপ্রকার ভীষণ আনন্দ আছে। যাহারা রাজনারায়ণবাবুর '‘একাল ও সেকাল পাঠ করিয়াছেন তাহারা জানেন, নূতন ইংরাজি শিক্ষা লাভ করিয়া বাঙালি ছাত্রেরা যখন হিন্দুকালেজ হইতে বাহির হইলেন তখন তাহদের কিরূপ মত্ততা জন্মিয়াছিল। র্তাহারা দলবদ্ধ হইয়া গুরুতর আঘাতে হিন্দুসমাজের হৃদয় হইতে রক্তপাত করিয়া তাঁহাই লইয়া প্রকাশ্য পথে আবীর খেলাইতেন। কঠোর অট্টহাস্য ও নিষ্ঠুর উৎসবের কোলাহল তুলিয়া তখনকার শ্মশানদৃশ্য র্তাহারা আরো ভীষণতর করিয়া তুলিয়াছিলেন। তাহাদের নিকট হিন্দুসমাজের কিছুই ভালো কিছুই পবিত্র ছিল না ; হিন্দুসমাজের যে-সকল কঙ্কাল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছিল তাঁহাদের ভালোরূপ সৎকার করিয়া শেষ ভস্মমুষ্টি গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করিয়া বিষন্নমনে যে গৃহে ফিরিয়া আসিবেন, প্রাচীন হিন্দুসমাজের স্মৃতির প্রতি তাহাদের ততটুকুও শ্রদ্ধা ছিল না। তাহারা কালভৈরবের অনুচর ভূতপ্রেতের ন্যায় শ্মশানের নরকপালে মদিরা পান করিয়া বিকট উল্লাসে উন্মত্ত হইতেন। সে সময়কার অবস্থা বিবেচনা করিলে তাহদের ততটা দোষ দেওয়া যায় না। প্ৰথম বিপ্লবের সময় এইরূপ ঘটিয়া থাকে। একবার ভাঙিবার দিকে মন দিলে প্ৰলয়ের আনন্দ উত্তরোত্তর বাড়িয়া উঠে। সে সময়ে খানিকটা খারাপ লাগিলেই সমস্তটা খারাপ লাগে,