পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চরিত্ৰপূজা ՂՀ Տ কর্মচেষ্টার মূলদেশ হইতে যে একাগ্ৰ নিষ্ঠ উর্ধর্বলোকে উঠিয়াছে তাহা আজ নিস্তব্ধভাবে প্রকাশমান। অদ্য তিনি তাহার এই বৃহৎ সংসারের বহিৰ্দ্ধারে আসিয়া দাড়াইয়াছেন, কিন্তু সংসারের সমস্ত সুখদুঃখ-বিচ্ছেদমিলনের মধ্যে যে অচলা শান্তি জননীর আশীর্বাদের ন্যায় চিরদিন তাহার অন্তরে ধ্রুব হইয়া ছিল তাহা দিনান্তকালের রমণীয় সূর্যস্তচ্ছটাির ন্যায় অদ্য র্তাহাকে বেষ্টন করিয়া উদভাসিত। হৃদয়েশ্বরের সহিত নির্বাধিমিলনের পথে যাত্ৰা করিবার জন্য প্ৰস্তুত হইয়াছেন। এই পুণ্যক্ষণে আমরা তাহাকে প্ৰণাম করিবার জন্য, তাহার সার্থকজীবনের শান্তিসৌন্দর্যমণ্ডিত শেষ রশ্মিচ্ছটা মস্তক পাতিয়া গ্ৰহণ করিবার জন্য, এখানে সমাগত হইয়াছি। বন্ধুগণ, র্যাহার জীবন আপনাদের জীবনশিখাকে ক্ষণে ক্ষণে উজ্জ্বল করিয়াছে, র্যাহার বাণী অবসাদের সময় আপনাদিগকে বল ও বিষাদের সময় আপনাদিগকে সাস্তুনা দিয়াছে, তাহার জন্মদিনকে উৎসবের দিন করিয়া আপনারা ভক্তিকে চরিতার্থ করিতে আসিয়াছেন, এইখানে আমি আমার পুত্ৰসম্বন্ধ লইয়া এই উৎসবদিনে যদি ক্ষণকালের জন্য পিতার নিকট বিশেষভাবে উপস্থিত হই, তবে আমাকে মার্জনা করিবেন। সন্নিকটবতী মহাত্মাকে সমগ্রভাবে সম্পূর্ণভাবে দেখিবার অবসর য়দের প্রায় ঘটে না। সংসারের সম্বন্ধ-বিচিত্র সম্বন্ধ, বিচিত্র স্বার্থ, বিচিত্র মত, বিচিত্র অনিত্য জিনিস নিত্য জিনিসকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে, সংসারের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে প্রকৃত পরিচয় প্রত্যহ খণ্ডিত হইয়া যায়। এইজন্যই পিতৃদেবের এই জন্মদিনের উৎসব তাহার আত্মীয়দের পক্ষে একটি বিশেষ শুভ অবসর। যে পরিমাণ দূরে দাড়াইলে মহত্ত্বকে আদ্যোপােন্ত অখণ্ড দেখিতে পাওয়া যায়, আদ্যকার এই উৎসবের সুযোগে বাহিরের ভক্তমণ্ডলীর সহিত একাসনে বসিয়া আমরা সেই পরিমাণ দূরে আসিব, র্তাহাকে ক্ষুদ্র সংসারের সমস্ত তুচ্ছ সম্বন্ধজাল হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিব, আমাদের সংকীর্ণ জীবনের প্রাত্যহিক ব্যবহারোৎক্ষিপ্ত সমস্ত ধূলিরাশিকে অপসারিত করিয়া তঁহাকে বৃহৎ আকাশের মধ্যে, নির্মল শান্তির মধ্যে, দেবপ্ৰসাদের অক্ষুন্ন আনন্দরশ্মির মধ্যে, তাহার যথার্থ মহিমায় তাহাকে তাহার জীবনের নিত্যপ্রতিষ্ঠার উপরে সমাসীন দেখিব। সংসারের আবর্তে উদভ্ৰান্ত হইয়া যত বিদ্রোহ, যত চপলিতা, যত অন্যায় করিয়াছি, অদ্য তাহার জন্য তাহার শ্ৰীচরণে একান্তচিত্তে । ক্ষমাপ্রার্থনা করিব— আজ তাহাকে আমাদের সংসারের, আমাদের সর্বজনের, অতীত করিয়া তাহাকে বিশ্বভুবনের ও বিশ্বভুবনেশ্বরের সহিত বৃহৎ নিত্যসম্বন্ধে যুক্ত করিয়া দেখিব এবং তঁাহার নিকট এই আশীৰ্বাদ প্রার্থনা করিব যে, যে চিরজীবনের ধনকে তিনি নিজের জীবনের মধ্যে সঞ্চিত করিয়াছেন সেই সঞ্চয়কেই যেন আমরা সর্বপ্রধান পৈতৃক সম্পত্তি বলিয়া গণ্য করি, তাহার জীবনের দৃষ্টান্ত যেন দৃঢ়তার মধ্যে আমাদিগকে ধারণ করিয়া রাখে এবং তিনি ঋষিদের যে মন্ত্র আমাদের কর্ণে ধ্বনিত করিয়াছেন, তাহা যেন কোনো আরামের জড়িত্বে, কোনো নৈরাশ্যের অবসাদে বিস্মৃত না হই— মাহং ব্ৰহ্ম নিরাকুর্যাং মা মা ব্ৰহ্ম নিরাকারোৎ | অনির্যাকরণমস্তু অনির্যাকরণং মেহন্তু ৷ বন্ধুগণ, ভ্রাতৃগণ, এই সপ্তাশীতিবষীয় জীবনের সম্মুখে দাড়াইয়া আনন্দিত হও, আশান্বিত হও । ইহা জানো যে, সত্যমেব জয়তে নান্যতম। ইহা জানো যে, ধর্মই ধর্মের সার্থকতা। ইহা জানো যে, আমরা যাহাকে সম্পদ বলিয়া উন্মত্ত হই তাহা সম্পদ নহে, যাহাকে বিপদ বলিয়া ভীত হই। তাহা বিপদ নহে; আমাদের অন্তরাত্মা, সম্পদ-বিপদের অতীত যে পরমা শান্তি তাহাকে আশ্রয় করিবার অধিকারী। ভুমাত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ। সমস্ত জীবন দিয়া ভূমাকেই জানিতে ইচ্ছা করো, এবং সমস্ত জীবনের মধ্যে ভূমাকেই সপ্রমাণ করো। এই প্রার্থনা করো, আবিরাবীর্ম এধি। হে স্বপ্ৰকাশ, আমার নিকটে