পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চারিত্রপূজা vrの○ ধৰ্মসমাজ দাড় করাইয়াছেন তাহার বর্তমান আকৃতি স্থায়ী না হইতেও পারে, কিন্তু তিনি সেই- যে অমৃত-উৎসের ধারে গিয়া নিজের জীবনকে ভরিয়া লইয়াছেন ইহাই আমাদের প্রত্যেকের লাভ। এই লাভ নষ্ট হইবে না, শেষ হইবে না। পূর্বেই বলিয়াছি, ঈশ্বরকে আর-কাহারও হাত দিয়া আমরা পাইব না। তাহার কাছে নিজে যাইতে হইবে, তাহাকে নিজে পাইতে হইবে। দুঃসাধ্য হয় সেও ভালো, বিলম্ব হয় তাহাতে ক্ষতি নাই। অন্যের মুখে শুনিয়া, উপদেশ পাইয়া, সমাজবিহিত অনুষ্ঠান পালন করিয়া আমরা মনে করি, যেন আমরা চরিতার্থতা লাভ করিলাম- কিন্তু সে তো ঘটির জল, সে তো উৎস নহে। তাহা মলিন হয়, তাহা ফুরাইয়া যায়, তাহাতে আমাদের সমস্ত জীবন অভিষিক্ত হয় না এবং তাহা লইয়া আমরা বিষয়ী লোকের মতোই অহংকার ও দলাদলি করিতে থাকি। এমন ঘটির জলে আমাদের চলিবে না— সেই উৎসের কাছে আমাদের প্রত্যেককেই যাইতে হইবে, ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের নিজের একান্ত সম্বন্ধ তাহার সম্মুখে গিয়া আমাদিগকে নিজে স্বীকার করিতে হইবে। সম্রাট যখন আমাকে দরবারে ডাকেন তখন প্ৰতিনিধি পাঠাইয়া কি কােজ সারিতে পারি ? ঈশ্বর যে আমাদের প্রত্যেককে ডাক দিয়াছেন, সেই ডাকে সাড়া দিয়া একেবারে সম্পূর্ণভাবে তাহার কাছে আত্মসমর্পণ করিতে না পারিলে কোনোমতেই আমাদের সার্থকতা নাই । মহাপুরুষদের জীবন হইতে এই কথাটাই আমরা জানিতে পারি। যখন দেখি তাহারা হঠাৎ সকল কাজ ফেলিয়া তাড়াতাড়ি ছুটিয়াছেন তখন বুঝিতে পারি, তবে তো আহবান আসিতেছে— আমরা শুনিতে পাই নাই, কিন্তু তাহারা শুনিতে পাইয়াছেন। তখন চারি দিকের কোলাহল হইতে ক্ষণকালের জন্য মনটাকে টানিয়া লই, আমরাও কান পাতিয়া দাড়াই। অতএব মহাপুরুষদের জীবন হইতে আমরা প্ৰথমে স্পষ্ট জানিতে পারি— আত্মার প্রতি পরমাত্মার আহবান কতখানি সত্য। এই জানিতে পারাটাই ०ो\eछ । তার পরে আর-একদিন তাহাদিগকে দেখিতে পাই সুখে দুঃখে তাহারা শাস্ত, প্রলোভনে তাহারা অবিচলিত, মঙ্গলব্রতে তাহারা দৃঢ়প্ৰতিষ্ঠ। দেখিতে পাই তাঁহাদের মাথার উপর দিয়া কত ঝড় চলিয়া যাইতেছে, কিন্তু তাহাদের হাল ঠিক আছে ; সর্বস্বাক্ষতির সম্ভাবনা র্তাহাদের সম্মুখে বিভীষিকারাপে আবির্ভূত হইয়াছে, কিন্তু তাহারা অনায়াসেই তাহাকে স্বীকার করিয়া ন্যায়াপথে ধ্রুব হইয়া আছেন ; আত্মীয়বন্ধুগণ তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিতেছে, কিন্তু তাহারা প্ৰসন্নচিত্তে সে-সকল বিচ্ছেদ বহন করিতেছেন- তখনই আমরা বুঝিতে পারি। আমরা কী পাই নাই। আর তাহারা কী পাইয়াছেন। সে কোন শান্তি, কোন বন্ধু, কোন সম্পদ! তখন বুঝিতে পারি। আমাদিগকেও নিতান্তই কী পাওয়া চাই, কোন লাভে আমাদের সকল অন্বেষণ শাস্ত হইয়া যাইবে। অতএব মহাপুরুষদের জীবনে আমরা প্ৰথমে দেখি তাহারা কোন আকর্ষণে সমস্ত ত্যাগ করিয়া চলিয়াছেন, তাহার পরে দেখিতে পাই কোন লাভে তাহাদের সমস্ত ত্যাগ সার্থক হইয়াছে। এই দিকে আমাদের মনের জাগরণটাই আমাদের লাভ। কারণ, এই জাগরণের অভাবেই কোনো লাভই সম্পন্ন হইতে পারে না। তার পরে যদি ভাবিয়া দেখি পাইবার ধন কোথায় পাওয়া যাইবে, কেমন করিয়া পাইব, তবে এই প্ৰশ্নই করিতে হইবে- তাহারা কোথায় গিয়াছেন, কেমন করিয়া পাইয়াছেন ! মহৰ্ষির জীবনে এই প্রশ্নের কী উত্তর পাই। দেখিতে পাই তিনি তাহার পূর্বতন সমস্ত সংস্কার, সমস্ত আশ্রয় পরিত্যাগ করিয়া একেবারে রিক্তহস্তে বাহির হইয়া পড়িয়াছেন। সমাজের প্রচলিত প্ৰথা তাহাকে ধরিয়া রাখে নাই, শাস্ত্র তাহাকে আশ্রয় দেয় নাই। তাহার ব্যাকুলতাই তাহাকে পথ দেখাইয়া চলিয়াছে। সে-পথ তাহার নিজেরই প্ৰকৃতির গভীর গোপন পথ। সব পথ ছাড়িয়া সেই পথ তাহাকে নিজে আবিষ্কার করিয়া লইতে হইয়াছে। এ আবিষ্কার করিবার ধৈর্য ও সাহস তাহার থাকিত না, তিনিও পাচজনের পথে চলিয়া, ধর্ম না হউক, ধামিকতা লাভ করিয়া সন্তুষ্ট থাকিতেন- কিন্তু তাহার পক্ষে যে “না পাইলে নয়’ হইয়া উঠিয়াছিল, সেইজন্য তাহাকে নিজের পথ নিজেকে বাহির করিতে হইয়াছিল।