পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় । br>> এই লোকালয়ের একটি যেন সজীব হৎস্পন্দন আমার বক্ষের উপর এসে আঘাত করতে লাগল । এই মেঘলা আকাশের নীচে, নিবিড় সন্ধ্যার মধ্যে, কত লোক, কত ইচ্ছা, কত কাজ, কত গৃহ, গৃহের মধ্যে জীবনের কত রহস্য- মানুষে মানুষে কাছাকাছি ঘেঁষাৰ্ঘেষি কত শতসহস্ৰ প্রকারের ঘাতপ্ৰতিঘাত । বৃহৎ জনতার সমস্ত ভালোমন্দ সমস্ত সুখদুঃখ এক হয়ে তরুলতাবেষ্টিত ক্ষুদ্র বর্ষানদীর দুই তীর থেকে একটি সকরুণ সুগম্ভীর রাগিণীর মতো আমার হৃদয়ে এসে প্ৰবেশ করতে লাগিল । আমার শৈশবসন্ধ্যা’ কবিতায় বোধ হয় কতকটা এই ভাব প্ৰকাশ করতে চেয়েছিলুম ! কথাটা সংক্ষেপে এই যে, মানুষ ক্ষুদ্র এবং ক্ষণস্থায়ী, অথচ ভালোমন্দ এবং সুখদুঃখপরিপূর্ণ জীবনের প্রবাহ সেই পুরাতন সুগভীর কলম্বরে চিরদিন চলছে ও চলবে- নগরের প্রান্তে সন্ধ্যার অন্ধকারে সেই চিরন্তন কলধ্বনি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে । মানুষের দৈনিক জীবনের ক্ষণিকতা ও স্বাতন্ত্র্য এই অবিচ্ছিন্ন সুরের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে, সবসুদ্ধ খুব একটা বিস্তৃত আদি অন্তশূন্য প্রশ্নোত্তরহীন মহাসমুদ্রের একতান শব্দের মতো অন্তরের নিস্তব্ধতার মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করছে । এক-এক সময়ে কোথাকার কোন ছিদ্র দিয়ে জগতের বড়ো বড়ো প্রবাহ হৃদয়ের মধ্যে পথ পায়- তার যে একটা ধ্বনি শোনা যায় সেটাকে কথায় তর্জমা করা অসাধ্য । [৬ জুলাই Sib S 8 —ছিন্নপত্র রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রের অন্য একটি চিঠিতে ‘অনাদৃত” (বা “জাল ফেলা”) কবিতাটির যে ব্যাখ্যা করেন তাহা নিমো সংকলিত হইল মনে করে একজন ব্যক্তি তার জীবনের প্রভাতকালে সমুদ্রের ধারে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সূর্যোদয় দেখছিল ; সে সমুদ্রটা তার আপনার মন কিংবা ঐ বাহিরের বিশ্ব কিংবা উভয়ের সীমানা-মধ্যবর্তী একটি ভাবের পারাবার সে কথা স্পষ্ট করে বলা হয় নি । যাই হোক, সেই অপূর্ব সৌন্দর্যময় অগাধ সমুদ্রের দিকে চেয়ে চেয়ে লোকটার মনে হল এই রহস্যপাথরের মধ্যে জাল ফেলে দেখা যাক-না। কী পাওয়া যায় ! এই বলে তো সে ঘুরিয়ে জাল ফেললে । নানারকমের অপরূপ জিনিস উঠতে লাগিল— কোনোটা বা হাসির মতো শুভ্ৰ, কোনোটা বা অশ্রুর মতো উজল, কোনোটা বা লজার মতো রাঙা । মনের উৎসাহে সে সমস্ত দিন ধরে ঐ কাজই কেবল করলে— গভীর তলদেশে যে-সকল সুন্দর রহস্য ছিল সেইগুলিকে তীরে এনে রাশীকৃত করে তুললে । এমনি করে জীবনের সমস্ত দিনটি যাপন করলে । সন্ধ্যার সময় মনে করলে, এবারকার মতো যথেষ্ট হয়েছে, এখন এইগুলি নিয়ে তাকে দিয়ে আসা যাক গে । কাকে যে সে কথাটা স্পষ্ট করে বলা হয় নি— হয়তো তার প্ৰেয়সীকে, হয়তো তার স্বদেশকে । কিন্তু যাকে দেবে সে তো এ-সমস্ত অপূর্ব জিনিস কখনো দেখে নি । সে ভাবলে, এগুলো কী, এর আবশ্যকতাই বা কী, এতে কী অভাব দূর হবে, দোকানদারের কাছে যাচিয়ে দেখলে এর কতই বা মূল্য হতে পারবে ! এক কথায়, এ বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস ভূগোল অর্থনীতি সমাজনীতি ধর্মনীতি তত্ত্বজ্ঞান প্রভৃতি কিছুই নয় ; এ কেবল কতকগুলো রঙিন ভাবমাত্র, তারও যে কোনটার কী নাম কী বিবরণ তারও ভালো পরিচয় পাওয়া যায় না । ফলত, সমস্ত দিনের জাল-ফেলা অগাধ সমুদ্রের এই রত্নগুলি যাকে দেওয়া গেল সে বললে, এ আবার কী ! জেলেরও মনে তখন অনুতাপ হল, সত্যি বটে, এ তো বিশেষ কিছু নয়, আমি কেবল জাল ফেলেছি আর তুলেছি ; আমি তো হাটেও যাই নি। পয়সাকড়িও খরচ করি নি, এর জন্যে তো আমাকে কাউকে এক পয়সা খাজনা কিম্বা মাশুল দিতে হয় নি । সে তখন কিঞ্চিৎ বিষগ্নমুখে লজিতভাবে সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে ঘরের দ্বারে বসে একে একে রাস্তায় ফেলে দিলে । তার পরদিন সকালবেলায় পথিকরা এসে সেই বহুমূল্য জিনিসগুলি দেশে বিদেশে আপনি আপনি ঘরে নিয়ে গেল । বোধ হচ্ছে, এই কবিতাটি যিনি