পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

এ কী কৌতুক নিত্যনুতন ওগাে কৌতুকময়ী ! / বিশ্ববিধির একটা নিয়ম এই দেখিতেছি যে, যেটা আসন্ন, যেটা উপস্থিত, তাহাকে সে খর্ব করিতে দেয় না । তাহাকে এ কথা জানিতে দেয় না যে, সে একটা সোপান পরম্পরার অঙ্গ । তাহাকে বুঝাইয়া দেয় যে, সে আপনাতে আপনি পর্যাপ্ত । ফুল যখন ফুটিয়া উঠে তখন মনে হয়। ফুলই যেন গাছের একমাত্র লক্ষ্য-- এমনি তাহার সৌন্দর্য, এমনি তাহার সুগন্ধ যে, মনে হয়, যেন সে বনলক্ষ্মীর সাধনার চরমধন- কিন্তু সে যে ফল ফলাইবার উপলক্ষমাত্র, সে কথা গোপন থাকে- বর্তমানের গৌরবেই সে প্ৰফুল্ল, ভবিষ্যৎ তাহাকে অভিভূত করিয়া দেয় না । আবার ফলকে দেখিলে মনে হয়, সেই যেন সফলতার চূড়ান্ত । কিন্তু ভাবী তরুর জন্য সে যে বীজকে গর্ভের মধ্যে পরিণত করিয়া তুলিতেছে, এ-কথা অন্তরালেই থাকিয়া যায় । এমনি করিয়া প্রকৃতি ফুলের মধ্যে ফুলের চরমতা, ফলের মধ্যে ফলের চরমতা রক্ষা করিয়াও তাঁহাদের অতীত একটি পরিণামকে অলক্ষে অগ্রসর করিয়া দিতেছে । কাব্যরচনার সম্বন্ধেও সেই বিশ্ববিধানই দেখিতে পাই ; অন্তত আমার নিজের মধ্যে তাহা উপলব্ধি করিয়াছি । যখন যেটা লিখিতেছিলাম তখন সেইটোকেই পরিণাম বলিয়া মনে করিয়াছিলাম । এইজন্য সেইটুকু সমাধা করার কাজেই অনেক যত্ন ও অনেক আনন্দ আকর্ষণ করিয়াছে । আমিই যে তাহা লিখিতেছি, এবং একটা কোনো বিশেষ ভাব অবলম্বন করিয়া লিখিতেছি, এ সম্বন্ধেও সন্দেহ ঘটে নাই। কিন্তু আজ জানিয়াছি সে-সকল লেখা উপলক্ষমাত্ৰ ; তাহারা যে অনাগতকে গড়িয়া তুলিতেছে সেই অনাগতকে তাহারা চেনেও না । তাহাদের রচিয়িতার মধ্যে আর-একজন কে রচনাকারী আছেন র্যাহার সম্মুখে সেই ভাবী তাৎপর্য প্রত্যক্ষ বর্তমান । ফুৎকার বাশির এক-একটা ছিদ্রের মধ্যে দিয়া এক-একটা সুর জাগাইয়া তুলিতেছে এবং নিজের কর্তৃত্ব উচ্চস্বরে প্রচার করিতেছে, কিন্তু কে সেই বিচ্ছিন্ন সুরগুলিকে রাগিণীতে বাধিয়া তুলিতেছে। ফু সুর জাগাইতেছে বটে, কিন্তু যুঁফ তো বাঁশি বাজাইতেছে না । সেই বঁাশি যে বাজাইতেছে তাহার কাছে সমস্ত রাগরাগিণী বর্তমান আছে, তাহার আগোচরে কিছুই নাই। — বলিতেছিলাম বসি এক ধারে আপনার কথা আপন জনারে, শুনাতেছিলাম ঘরের দুয়ারে