পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ >ぬ> বসে লম্বা দাড়ি দুই ভাগ করে বার বার আঁচড়িয়ে দুই কনের উপর বাধে, নিম্নতন দারোয়ানরা তলোয়ার হাতে পাহারা দেয় । দেউড়ির দেওয়ালে ঝোলে নানা রকমের ঢাল, বাক তলোয়ার, বহুকালের পুরানো বন্দুক বল্লম বশ । বৈঠকখানায় মুকুন্দলাল বসেন গদির উপর, পিঠের কাছে তাকিয়া। পারিষদের বসে নীচে, সামনে বঁায়ে দুই ভাগে । হুকাবরদারের জানা আছে, এদের কার সম্মান কোন রকম হুকোয় রক্ষা হয়— বাধানে, আবাধানে, না গুড়গুড়ি। কর্তমহারাজের জন্যে বৃহৎ আলবোল, গোলাপজলের গন্ধে সুগন্ধি । বাড়ির আর-এক মহলে বিলিতি বৈঠকখানা, সেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিলিতি আসবাব। সামনেই কালোদাগ-ধরা মস্ত এক আয়না, তার গিলটি-করা ফ্রেমের দুই গায়ে ডানাওআল পরীমূর্তির হাতে-ধরা বাতিদান। তলায় টেবিলে সোনার জলে চিত্রিত কালো পাথরের ঘড়ি, আর কতকগুলো বিলিতি কাচের পুতুল। খাড়াপিঠ-ওআল। চৌকি, সোফা, কড়িতে দোদুল্যমান ঝাড়লণ্ঠন, সমস্তই হল্যাণ্ড-কাপড়ে মোড়া। দেয়ালে পূর্বপুরুষদের অয়েলপেন্টিং, আর তার সঙ্গে বংশের মুরুব্বি দু-একজন রাজপুরুষের ছবি। ঘরজোড় বিলিতি কাপে ট, তাতে মোটা মোট ফুল টকটকে কড়া রঙে আঁক| বিশেষ ক্রিয়াকর্মে জিলার সাহেবসুবাদের নিমন্ত্রণোপলক্ষে এই ঘরের অবগুণ্ঠন মোচন হয়। বাড়িতে এই একটা মাত্র আধুনিক ঘর, কিন্তু মনে হয় এইটেই সবচেয়ে প্রাচীন ভূতে-পাওয়া কামরা, অব্যবহারের রুদ্ধ ঘনগন্ধে দম-আটকানো দৈনিক জীবনযাত্রার সম্পর্কবঞ্চিত বোবা। মুকুন্দলালের যে শৌখিনত সেটা তখনকার আদবকায়দার অত্যাবশ্বক অঙ্গ । তার মধ্যে যে নির্ভীক ব্যয়বাহুল্য, সেইটেতেই ধনের মর্যাদা। অর্থাং ধন বোঝা হয়ে মাথায় চড়ে নি, পাদপীঠ হয়ে আছে পায়ের তলায়। এদের শৌখিনতার আমদরবারে দানদাক্ষিণ্য, খাসদরবারে ভোগবিলাস— দুই খুব টানা মাপের । এক দিকে আশ্রিতবাৎসল্যে যেমন অকৃপণতা, আর-এক দিকে ঔদ্ধত্যদমনে তেমনি অবাধ অধৈর্য । একজন হঠাৎ-ধনী প্রতিবেশী গুরুতর অপরাধে কর্তার বাগানের মালীর ছেলের কান মলে দিয়েছিল মাত্র ; এই ধনীর শিক্ষাবিধান-বাবদ যত খরচ হয়েছে, নিজের ছেলেকে কলেজ পার করতেও এখনকার দিনে এত খরচ করে না। অথচ মালীর ছেলেটাকেও অগ্রাহ করেন নি। চাবকিয়ে তাকে শয্যাগত করেছিলেন । রাগের চোটে চাবুকের মাত্রা বেশি হয়েছিল বলে ছেলেটার উন্নতি হল। সরকারি খরচে পড়াশুনো করে সে আজ মোক্তারি করে । পুরাতন কালের ধনবানদের প্রথামত মুকুন্দলালের জীবন দুই-মহলা। এক