পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sæbr রবীন্দ্র-রচনাবলী সঙ্গে মানুষের এক-একটি পরব বাধা । অক্ষয়তৃতীয়া থেকে দোলযাত্র বাসন্তীপুজো পর্যন্ত কত কী। মানুষে প্রকৃতিতে হাত মিলিয়ে সমস্ত বছরটিকে যেন নানা কারুশিল্পে বুনে তুলছে। সবই যে স্বন্দর, সবই যে মুখের তা নয়। মাছের ভাগ, পুজোর পার্বণী, কত্রীর পক্ষপাত, ছেলেদের কলহে স্ব-স্ব ছেলের পক্ষসমর্থন প্রভৃতি নিয়ে নীরবে ঈর্ষা বা তারস্বরে অভিযোগ, কানে কানে পরচর্চা বা মুক্তকণ্ঠে অপবাদঘোষণা, এ-সমস্ত প্রচুর পরিমাণেই আছে– সবচেয়ে আছে নিত্যনৈমিত্তিক কাজের ব্যস্ততার ভিতরে ভিতরে নিয়ত একটা উদ্বেগ— কর্তা কখন কী করে বসেন, র্তার বৈঠকে কখন কী দুর্যোগ আরম্ভ হয়। যদি আরম্ভ হল তবে দিনের পরে দিন শাস্তি নেই। কুমুদিনীর বুক দুর দুর করে, ঘরে লুকিয়ে মা কাদেন, ছেলেদের মুখ শুকনো। এই-সমস্ত শুভে অশুভে সুখে দুঃখে সর্বদা আন্দোলিত প্রকাগু সংসারযাত্রা। এরই মধ্য থেকে কুমুদিনী এল কলকাতায় । এ যেন মস্ত একটা সমুদ্র কিন্তু কোথায় একফোট পিপাসার জল ? দেশে আকাশের বাতাসেরও একটা চেন। চেহারা ছিল । গ্রামের দিগন্তে কোথাও-বা ঘন বন, কোথাও-বা বালির চর, নদীর জলরেখা, মন্দিরের চূড়ো, শূন্য বিস্তৃত মাঠ, বুনো ঝাউয়ের ঝোপ, গুণটানা পথ— এর নানা রেখায় নানা রঙে বিচিত্র ঘের দিয়ে আকাশকে একটি বিশেষ আকাশ করে তুলেছিল— কুমুদিনীর আপন আকাশ। স্বর্যের আলোও ছিল তেমনি বিশেষ আলে। দিঘিতে, শস্তখেতে, বেতের ঝাড়ে, জেলে-নৌকোর খয়েরি রঙের পালে, বঁাশঝাড়ের কচি ডালের চিকন পাতায়, কাঠালগাছের মসৃণ-ঘন সবুজে, ও পারের বালুতটের ফ্যাকাশে হলদেয়— সমস্তর সঙ্গে নানা ভাবে মিশিয়ে সেই আলো একটি চিরপরিচিত রূপ পেয়েছিল। কলকাতার এই-সব অপরিচিত বাড়ির ছাদে দেয়ালে কঠিন অনস্ত্র রেখার আঘাতে নানাখানা হয়ে সেই চিরদিনের আকাশ আলে৷ তাকে বেগান লোকের মতো কড়া চোখে দেখে । এখানকার দেবতাও তাকে একঘরে করেছে । বিপ্রদাস তাকে কেদারার কাছে টেনে নিয়ে বলে, “কী কুমু, মন কেমন করছে ?” কুমুদিনী হেসে বলে, “না দাদা, একটুও না।” “যাবি বোন, মুজিয়ম দেখতে ?” “হঁ্য যাব।” এত বেশি উৎসাহের সঙ্গে বলে যে, বিপ্রদাস যদি পুরুষমানুষ না হত তবে বুঝতে পারত যে এটা স্বাভাবিক নয়। মুজিয়মে না যেতে হলেই সে বঁাচে । বাইরের লোকের ভিড়ের মধ্যে বেরোনো অভ্যেস নেই বলে জনসমাগমে যেতে তার