পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ९S S কথাটা নিতান্ত অসংগত নয়, কিন্তু আত্মীয়স্বজনেরা খুত খুত করতে লাগল। প্রজারা বলে, এটা আমাদের কর্তাবাবুদের উপর টেক্কা দেবার চেষ্টা । হঠাৎ তবিল ফেঁপে উঠেছে, সেটা ঢাকা দিতে পারছে না; সেটাকে জয়ঢাক করে তোলবার জন্যেই না এই কাণ্ড ? সাবেক আমল হলে বরস্থদ্ধ বরসজ্জা বৈতরণী পার করতে দেরি হত না। ছোটোবাৰু থাকলে তিনিও সইতেন না, দেখা যেত ওই বাবুগুলো আর তাবুগুলো থাকত কোথায় । প্রজার এসে বিপ্রদাসকে বললে, “হুজুর, ওদের কাছে হটতে পারব না। যা খরচ লাগে আমরাই দেব।” ছয়-আনার কর্তা নবগোপাল এসে বললে, “বংশের অমর্যাদা সওয়া যায় না। একদিন আমাদের কর্তারা ওই ঘোষালদের হাড়ে হাড়ে ঠকাঠকি লাগিয়েছেন, আজি তারা আমাদেরই এলাকার উপর চড়াও হয়ে টাকার ঝলক মারতে এসেছে । ভয় নেই দাদা, খরচ যা লাগে আমরাও আছি। বিষয় ভাগ হোক, বংশের মান তো ভাগ হয়ে যায় নি।” এই বলে নবগোপালই ঠেলেঠলে কর্মকর্তা হয়ে বসল। বিপ্রদাস কয়দিন কুমুর কাছে যেতে পারে নি। তার মুখের দিকে তাকাবে কী করে ? কুমুর কাছে বরপক্ষের স্পর্ধার কথা কেউ যে গল খাটো করে বলবে সমাজে সে দয়া বা ভদ্রতা নেই। তারই কাছে সবাই বাড়িয়ে-বাড়িয়ে বলে । মেয়েদের রাগ তারই পরে। ওরই জন্যে পূর্বপুরুষের মাথা যে হেঁট হল। রাজরানী হতে চলেছেন । কী যে রাজার ছিরি ! জাতকুলের কথাটাকে কুমু তার ভক্তি দিয়ে চাপা দিয়েছিল। কিন্তু ধনের বড়াই করে শ্বশুরকুলকে খাটো করার নীচতা দেখে তার মন বিষাদে ভরে উঠল। কেবলই লোকের কাছ থেকে সে পালিয়ে বেড়ায়। ঘোষালদের লজ্জায় আজ যে ওরই লজ্জা । দাদার মুখ থেকে কিছু শোনবার জন্যে মনটা ছট্‌ফট্‌ করছে। কিন্তু দাদার দেখা নেই, অন্দরমহলে খেতেও আসে না। একদিন বিপ্রদাস অন্তঃপুরের বাগানে ভিয়েনঘরের জন্যে চালা বঁধবার জায়গা "ঠিক করতে গিয়ে হঠাৎ খিড়কির পুকুরের ঘাটে দেখে, কুমু নীচের পৈঠের উপর বসে মাথা হেঁট করে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। দাদাকে দেখে তাড়াতাড়ি উপরে উঠে এল। এসেই রুদ্ধস্বরে বললে, “দাদা, কিছুই বুঝতে পারছি নে।” বলেই মুখে কাপড় দিয়ে কেঁদে উঠল । দাদা ধীরে ধীরে পিঠে হাত বুলিয়ে বললে, “লোকের কথায় কান দিস নে বোন।”