পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ А. २२१ পায়ের মাপট মেয়েমানুষের পক্ষে অধিক বড়ো। গায়ের প্রত্যেক গয়নাটি নেড়েচেড়ে বিচার করতে বসল— সেকেলে গয়না, ওজনে ভারি, সোন খাটি— কিন্তু কী ফ্যাশান, মরে যাই ! ওদের গাড়িতে স্টেশন-প্ল্যাটফর্মের উলটো দিকের জানলা খোলা ছিল, সেই দিকে কুমু চেয়ে রইল, চেষ্টা করতে লাগল এদের কথা যাতে কানে না যায়। দেখতে পেলে একটা এক-পা-কাট কুকুর তিন পায়ে খোড়াতে খোড়াতে মাটি শুকে বেড়াচ্ছে। আহা, কিছু খাবার যদি হাতের কাছে থাকত ! কিছুই ছিল না। কুমু মনে মনে ভাবতে লাগল, যে-একটি পা গিয়েছে তারই অভাবে ওর যা-কিছু সহজ ছিল তার সমস্তই হয়ে গেল কঠিন। এমন সময় কুমুর কানে গেল সেলুন-গাড়ির সামনে দাড়িয়ে একজন ভদ্রলোক বলছে, “দেখুন, এই চাষির মেয়েকে আড়কাটি আসাম চা-বাগানে ভুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, পালিয়ে এসেছে ; গোয়ালন্দ পর্যন্ত টিকিটের টাকা আছে, ওর বাড়ি দুমরাও, যদি সাহায্য করেন তো এই মেয়েটি বেঁচে যায়।” সেলুন-গাড়ি থেকে একটা মস্ত তাড়ার আওয়াজ কুমু শুনতে পেলে। সে আর থাকতে পারলে না, তখনই ডান দিকের জানলা খুলে তার পুতিগাথা থলে উজাড় করে দশ টাকা মেয়েটির হাতে দিয়েই জানলা বন্ধ করে দিলে। দেখে একজন মেয়ে বলে উঠল, “আমাদের বউয়ের দরাজ হাত দেখি !” আর-একজন বললে, “দরাজ নয় তো দরজা, লক্ষ্মীকে বিদায় করবার।” আর-একজন বললে, “টাকা ওড়াতে শিখেছে, রাখতে শিখলে কাজে লাগত।” এটাকে ওরা দেমাক বলে ঠিক করলে— বাবুর যাকে এক পয়সা দিলে না, ইনি তাকে অমনি ঝনাৎ করে টাকা ফেলে দেন, এত কিসের গুমোর ! ওদের মনে হল এও বুঝি সেই চাটুজ্যে-ঘোষালদের চিরকেলে রেষারেষির অঙ্গ । এমন সময়ে ওদের মধ্যে একটি মোটাসোটা কালোকোলে মেয়ে, মস্ত ডাগর চোখ, স্নেহরসে ভরা মুখের ভাব, কুমুর সমবয়সী হবে, ওর কাছে এসে বসল। চুপি চুপি বললে, “মন কেমন করছে ভাই ? এদের কথায় কান দিয়ে না, দু-দিন এইরকম টেপাটেপি বলাবলি করবে, তার পরে কণ্ঠ থেকে বিষ নেমে গেলেই থেমে যাবে।” এই মেয়েটি কুমুর মেজো জা, নবীনের স্ত্রী। ওর নাম নিস্তারিণী, ওকে সবাই মোতির মা বলে ডাকে। 跟 মোতির মা কথা তুললে, "যেদিন মুরনগরে এলুম, ইষ্টিশনে তোমার দাদাকে দেখলুম যে ।” কুমু চমকে উঠল। ওর দাদা যে স্টেশনে অভ্যর্থনা করতে গিয়েছিল সে খবর এই প্রথম শুনলে ।