পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৩8 রবীন্দ্র-রচনাবলী २२ মধুসূদন যখন কলকাতায় বাস করতে এল, তখন প্রথমে সে একটি পুরোনো বাড়ি কিনেছিল, সেই চকমেলানো বাড়িটাই আজ তার অন্তঃপুর-মহল। তার পরে তারই সামনে এখনকার ফ্যাশানে একটা মস্ত নতুন মহল এরই সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে, সেইটে ওর বৈঠকখানা-বাড়ি। এই দুই মহল যদিও সংলগ্ন তবুও এরা সম্পূর্ণ আলাদা দুই জাত। বাইরের মহলে সর্বত্রই মার্বলের মেজে, তার উপরে বিলিতি কর্পেট, দেয়ালে চিত্রিত কাগজ মারা এবং তাতে ঝুলছে নানারকমের ছবি— কোনোটা এনগ্ৰেভিং, কোনোট ওলিয়োগ্রাফ, কোনোটা অয়েলপেটিং— তার বিষয় হচ্ছে, হরিণকে তাড়া করেছে শিকারী কুকুর, কিম্বা ডার্বির ঘোড়দৌড়. জিতেছে এমন সব বিখ্যাত ঘোড়, বিদেশী ল্যাণ্ড স্কেপ, কিম্বা স্নানরত নগ্নদেহ নারী। তা ছাড়া দেয়ালে কোথাও বা চীনে বাসন, মোরাদাবাদী পিতলের থালা, জাপানি পাখা, তিব্বতি চামর ইত্যাদি যতপ্রকার অসংগত পদার্থের অস্থানে অযথা । সমাবেশ। এই সমস্ত গৃহসজ্জা পছন্দকর, কেন এবং সাজানোর ভার মধুসূদনের ইংরেজ অ্যাসিস্টাণ্টের উপর। এ ছাড়া মকমলে বা রেশমে মোড়া চৌকি-সোফার অরণ্য। কাচের অালমারিতে জমকালো-বাধানো ইংরেজি বই, ঝাড়ন-হস্ত বেহার ছাড়া কোনো মানুষ তার উপর হস্তক্ষেপ করে না— টিপাইয়ে আছে অ্যালবাম, তার কোনোটাতে ঘরের লোকের ছবি, কোনোটাতে বিদেশিনী অ্যাক্টে সদের। অন্তঃপুরে একতলার ঘরগুলো অন্ধকার, স্যাতসেঁতে, ধোয়ায় ঝুলে কালো। উঠোনে আবর্জনা— সেখানে জলের কল, বাসন মাজা কাপড় কাচা চলছেই, যখন ব্যবহার নেই তখনও কল প্রায় খোলাই থাকে। উপরের বারান্দা থেকে মেয়েদের ভিজে কাপড় ঝুলছে, আর দাড়ের কাকাতুয়ার উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে উঠোনে । বারান্দার দেয়ালের যেখানে-সেখানে পানের পিকের দাগ ও নানাপ্রকার মলিনতার অক্ষয় স্মৃতিচিহ্ন। উঠোনের পশ্চিম দিকের রোয়াকের পশ্চাতে রান্নাঘর, সেখান থেকে রান্নার গন্ধ ও কয়লার ধোয়া উপরের ঘরে সর্বত্রই প্রসার লাভ করে। রান্নাঘরের বাইরে প্রাচীরবদ্ধ অল্প একটু জমি আছে, তারই এক কোণে পোড়া কয়লা, চুলোর ছাই, ভাঙা গামল, ছিন্ন ধাম, জীর্ণ ঝাঝরি রাশীকৃত ; অপর প্রাস্তে গুটি-ফুয়েক গাই ও বাছুর বাধা, তাদের খড় ও গোবর জমছে, এবং সমস্ত প্রাচীর ঘুটের চক্রে আচ্ছন্ন। এক ধারে একটি মাত্র নিমগাছ, তার গুড়িতে গোরু বেঁধে বেঁধে বাকল গেছে উঠে, আর ক্রমাগত ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে তার পাতা কেড়ে নিয়ে